- Advertisement -

রপ্তানিযোগ্য ফসল গোয়ালগাদ্দা সীম: উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা

রপ্তানিযোগ্য ফসল: গোয়ালগাদ্দা সীম

0 1,873

- Advertisement -

গোয়ালগাদ্দা সীম: উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা

কৃষিবিদ মোহাইমিনুর রশিদ

সীম লিগিউম পরিবার ভূক্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ সবজি। যা বাংলাদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয়। দেশের সর্বত্রই বাণিজ্যিক ভাবে ও বসত বাড়ীতে এর চাষ হচ্ছে। সীমের ভক্ষনযোগ্য অংশ হলোঃ কচি শুটি বা পড এবং পরিপক্ক বীজ। শীমের উভয় অংশেই ক্যালসিয়াম, ভিটামিন সি, ক্যারোটিন বিদ্যমান। বিশেষ করে প্রোটিনের পরিমাণ বেশি। আঁশ জাতীয় উপাদান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শীম ভাজি, ভর্ত্তা, তরকারি হিসেবে খাওয়া যায়। সীম সাধারণতঃ শীতকালীন সবজি। তবে ইদানিং গ্রীষ্মকালে এর চাষ সম্প্রসারিত হয়েছে। সীমের নানা জাত আছে। তবে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের গোলাপগঞ্জ উপজেলায় গোয়ালগাদ্দা নামে একপ্রকার সীম চাষ করা হয়।

গোয়ালগাদ্দা সীমের জাত পরিচিতি

এ জাতের সীম গাছ, কান্ড ও পাতা সবুজ রঙের। গাছ লতানো স্বভাবের এবং দ্রুত বাড়ে ও শাখা প্রশাখা বেশী হয়। পুস্প মন্জরীরে গোলাপী ও সাদা ফুল হয়। প্রতি মন্জরীতে ৮ থেকে ১০ টি সীম ধরে। সীম লম্বায় ১২ থেকে ১৫ সেঃ মিঃ এবং পাশে ২.৫-৩.0 সেঃ মিঃ হয়। পডের গড় ওজন ১৫ থেকে ১৮ গ্রাম, প্রতি পডে ৪ থেকে ৫ টি বীজ থাকে। পড সবুজ, মাংসল, নরম ও সুদ্বাদু। গাছ প্রতি ৪৫০ থেকে ৫০০ টি সীম ধরে। ভাইরাস ও অন্যান্য রোগবালাই, পোকামাকড়ের আক্রমনও কম হয়। ভাদ্রের মাঝামাঝি থেকে আশ্বিনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বীজ বপন করা হয়। নভেম্বর মাসের প্রথমেই সীম সংগ্রহ করা যায়। এ জাতের সীমের জীবনকাল ১৩০ থেকে ১৬০ দিন (বীজ সংগ্রহ পর্যন্ত)। প্রায় হেক্টর প্রতি ফলন ২০ থেকে ২২ টন।

মাটি ও জলবায়ু: সুনিষ্কাাশিত দোঁআশ ও বেলে দোঁয়াশ মাটি সীম চাষের জন্য ভাল। তাপমাত্রা ও দিনের দৈর্ঘ্য এর ওপর সীম ফসলের অঙ্গজ বৃদ্ধি ও প্রজনন পর্যায় নির্ভর করে। এ সবজি অঙ্গজ বৃদ্ধির জন্য উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু এবং দীর্ঘ দিবস প্রয়োজন। আবার প্রজনন ধাপের জন্য নিম্ন আপমাত্রা সম্বলিত জলবায়ু এর সাথে হ্রাস দিবস প্রয়োজন। সীম যখনই বপন করা হউক না কেন শীতের প্রভাব না পরলে পুস্পায়ন ঘটে না।

বীজ বপনের সময় ও বীজের হার: ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি থেকে বীজ বপন করা হয়। বপনের সময় দুরত্ব এবং বপন পদ্ধতির উপর বীজের হার নির্ভর করে। সাধারণভাবে প্রতি হেক্টরে ৭.৫ কেজি, একরে ৩.০ কেজি এবং শতকে ৩০ গ্রাম বীজ লাগে।

জমি তৈরী: জমি ৪ থেকে ৫ টি চাষ দিয়ে মাটি ঢেলা ভেঙ্গে খুব পরিপাটি করে তৈরি করতে হয়। এরপর সমতল জমিতে নিদিষ্ট দুরত্বে উঁচু মাদা তৈরী করে বীজ বপন বা চারা রোপন করা যায়। তবে সেচ ও পানি নিকাশের সুবিধা এবং পরবর্তী পরিচর্যার সুবিধার জন্য বেড তৈরী করে বেডে বীজ বপন করা সবচেয়ে ভাল। বেড ১৫ থেকে ২৫ সেঃ মিঃ উঁচু এবং ২.৫ মিটার প্রশস্ত হবে। জমির প্রকৃতি এবং কাজের সুবিধা বিবেচনা করে বেড যত ইচ্ছা লম্বা করা যেতে পারে। সেচ ও পানি নিকাশের সুবিধার জন্য পাশাপাশি দুটি বেডের মাঝখানে ৫০ সেঃ মিঃ প্রশস্ত এবং ১৫ থেকে ২৫ সেঃ মিঃ গভীর নালা রাখতে হয়। ২.৫ মিটার প্রশস্ত বেডের উভয় পার্শ্বে ৫০ সেঃ মিঃ করে বাদ দিয়ে ১.৫ মিটার দূরত্বে বেডে লম্বালম্বি  দুটি লাইন টেনে নিতে হবে। দুই লাইন বা সারিতে ১.৫ মিটার দূরে দূরে ৩০.০ বাই ৩০.০ বাই ৩০.০ সেঃ মিঃ সাইজের মাদা তৈরী করতে হবে। তাছাড়া দুটি বেডের মধ্যে ৫০.০ সেঃ মিঃ প্রশস্ত নালা থাকায় পাশাপাশি দুটি সারির নিকটতম সারি দুটির দুরত্ব হল ১.৫ মিটার। তবে আজকাল ১ মিটার প্রস্থ বেডে ও একক সারি পদ্ধতিতে ১.০ থেকে ১.৫ মিটার দূরত্বে বীজ বপন/চারা রোপন করা হচ্ছে। উভয় পদ্ধতিতে একক আয়তনের জমিতে সমসংখ্যক গাছ সংকুলান হয়। তবে দ্বিতীয় পদ্ধতিতে গাছের পরিচর্যা ও ফসল উত্তোলন কার্যক্রম পরিচালনা সুবিধা জনক।

সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি: সীম ডাল জাতীয় শস্য। এতে সারের পরিমাণ বিশেষ করে নাইট্রোজেন সারের পরিমাণ কম লাগে। জমির শেষ চাষের সময় সম্পুর্ণ গোবর সার (১০০০০ কেজি/হেক্টর), জিপসাম ( ৫ কেজি/হেক্টর) ও বোরিক এসিড (৫ কেজি/হেক্টর) সবটুকু ছিটিয়ে জমিতে প্রয়োগ করে চাষ দিয়ে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। বীজ বপন বা চারা রোপনের ৪ থেকে ৫ দিন আগেই ইউরিয়া ও এমপি (পটাস) সারের অর্ধেক এবং টিএসপি সারের সবটুকু একত্রে ছিটিয়ে প্রয়োগ করে মাদার মাটির সাথে (১০ সেঃ মিঃ গভীর পর্যন্ত) কোদালের দ্বারা হালকা কোপ দিয়ে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। বপন/রোপনের ৩০ দিন পর বাকী অর্ধেক ইউরিয়া ও এমপি সার মাদায় উপরি প্রয়োগ করতে হবে। এক্ষেত্রে হেক্টর প্রতি ২৫ কেজি ইউরিয়া, ৯০ কেজি টিএসপি ও ৬০ কেজি এমওপি সার ব্যবহার করলে ভাল হয়।

বীজ বপন বা চারা রোপণ: সুপারিশকৃত মাত্রায় সার প্রয়োগ ও মাদা তৈরীর ৪ থেকে ৫ দিন পর মাদায় বীজ বপন বা চারা রোপণ করতে হবে। সাধারণত বীজ সরাসরি মাদায় বপন করা হয়। তবে পলি ব্যাগে চারা তৈরী করেও মাদায় চারা রোপণ করা যেতে পারে। পলিব্যাগে চারা তৈরী করলে ১০ থেকে ১৫ দিন বয়সের চারা ২ থেকে ৩টি পাতা বিশিষ্ট হলে মাদায় রোপণ উত্তম। কারণ সীম চারা ডগা লতানো শুরু করলে সে চারার অঙ্গজ বৃদ্ধি বিলম্বিত হয়। পক্ষান্তরে সঠিক বয়সে চারা লাগালে তার অঙ্গজ বৃদ্ধি ভাল হয়। জমিতে যদি পর্যাপ্ত রস না থাকে বীজ/চারা রোপনের পর অবশ্যই পানি দিতে হবে।

পরবর্তী পরিচর্যা
বপনকৃত বীজ থেকে চারা বের হওয়ার ৮ থেকে ১০ দিনের মধ্যেই প্রতিটি মাদায় একটি করে সুস্থ ও সবল চারা রেখে বাকিগুলি উঠিয়ে ফেলতে হবে। সীমের ক্ষেত সর্বদা আগাছা মুক্ত রাখতে হবে। গাছ ২৫ থেকে ৩০ সেঃ মিঃ উচু হলেই বাউনী দিতে হবে এবং মাচা তৈরী করে সীম গাছকে বাইতে দিতে হবে। তবে চারা গাছ মাচায় উঠা পর্যন্ত গোড়ার দিকে যেন না প্যাচাতে পারে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। পর্যবেক্ষনে দেখা গেছে যে, গোড়া প্যাচানো না দিলে গাছের বৃদ্ধি ও ফলন প্রায় ১০ থেকে ১৫% বেশী হয়। বীজ বপনের ৩০ দিন পরেই ইউরিয়া এবং এমপি (পটাশ) সারের উপরি প্রয়োগ করে সেচ দিতে হবে। মাটির রস যাচাই করে ১০ থেকে ১৫ দিন পর সেচ দিতে হবে। পুরাতন পাতা ও ফুল বিহীন ডগা/শাখা কেটে ফেলতে হবে।

ফসল সংগ্রহ ও ফলন
বীজ বপনের ৯৫ থেকে ১৪৫ দিন পর সীমের পড গাছ থেকে উঠিয়ে বাজারজাত করা যায়। ফুল ফোটার ২৫ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে সীম তোলার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। ৫ থেকে ৭ দিন অন্তর অন্তর গাছ থেকে সীম ফসল উঠালে মোট ১৪ থেকে ১৬ বার গুনগতমান সম্পন্ন পড সংগ্রহ করা যায় এবং এতে হেক্টর প্রতি প্রায় ১৫ থেকে ২০ টন সীম পাওয়া যায়। শতকে ৬০ থেকে ৮০ কেজি।

পোকা মাকড় ব্যবস্থাপনা

জাব পোকা
জাব পোকা সীমের একটি প্রধান ক্ষতিকারক পোকা। সীমের পূর্ণাঙ্গ জাব পোকা বেগুনী বা কালো রংয়ের হয়। অপ্রাপ্তবয়স্ক এবং প্রাপ্তবয়স্ক উভয় অবস্থাতেই গাছের নতুন ডগা, পাতা, ফুল, ফল ইত্যাদির রস চুষে খায় এবং গাছের বৃদ্ধি এবং ফলনে মারাত্নক ক্ষতি করে। সরাসরি ক্ষতি করা ছাড়াও এ পোকা মোজাইক জাতীয় ভাইরাস রোগ ছড়িয়ে রোগের বিস্তার ঘটিয়ে থাকে। নিমের তৈল ও তামাক পাতা ব্যবহার করে ভালো ফল পাওয়া যায়। ২০ মিলি নিমের তৈল ৬০ গ্রাম সাবানের গুড়ার সাথে মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করে তা ১০ লিটার পানির সাথে মিশাতে হবে। অতপর মিশ্রনটি ছেকে স্প্রে করতে হবে। তামাকের পাতা গুড়া একরাত পানিতে ভিজিয়ে রেখে তা ছেকে পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করে জাব পোকা দমন করা যায়।

সীমের ফল ছিদ্রকারী পোকা
ডিম থেকে বের হয়ে আসা কীড়া ফুল, ফুলের কুঁড়ি, কচি ফল ছিদ্র করে ভিতরে ঢোকে এবং ভিতরের শাঁস খেয়ে নষ্ট করে। ফলে এগুলো ঝরে পড়ে। আক্রান্ত সীম অনেক সময় কুঁকড়ে যায় এবং অসময়েই ঝরে পড়ে। আক্রমনের মাত্রা বেশী হলে সীমের ফলন মারত্বকভাবে হ্রাস পেতে পারে। এই পোকার কীড়ার মাথা গাঢ় বাদামী থেকে কালো রংয়ের। দেহ হলদে সাদা বর্ণের। কীড়ার পীঠে লম্বালম্বি লালচে ফোটা দেখা যায়। পূর্নাঙ্গ পোকা দেখতে কালচে ছাই রংয়ের। নীচের পাখা সাদা তুলার মত। ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার। প্রতি একদিন পর পর আক্রান্ত ফুল ও ফল হাত দিয়ে সংগ্রহ করে কমপক্ষে একহাত গভীর গর্ত করে পুতে ফেলতে হবে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ করা ও ঝরা ফুল, ফল ইত্যাদি সংগ্রহ করে নষ্ট করে ফেলা। আক্রমনের মাত্রা বেশী হলে অন্তর্বাহী বিষ ক্রিয়া সম্পন্ন কীটনাশক প্রয়োগ করা যেতে পারে।

থ্রিপস পোকা
থ্রিপস পোকার আক্রমনে সীমের উৎপাদন ব্যপকভাবে হ্রাস পেতে পারে। শুষ্ক আবহাওয়ায় থ্রিপস সীম গাছের ক্ষতিসাধন করে থাকে। জাব পোকার মতই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

সীমের রোগবালাই ব্যবস্থাপনা

এনথ্রাকনোজ বা ফলপঁচা

পাতায় বৃত্তাকার বাদামী দাগ ও তার চারপাশে হলুদাভ বলয় দেখা যায়। পরিণত ফলে প্রথমে ছোট গোলাকার জলবসা কলো দাগ পড়ে এবং দাগ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। ফলে দাগের কিনারা বরাবর চারপাশে কালো রঙের বেস্টনি দেখা যায়। কাঁচা অবস্থায় এ রোগের সংক্রমণ শুরু হয় এবং পাকার সময় ফলে বসানো দাগ দেখা যায় । পাকা ফল বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আক্রান্ত বীজ থেকে গজানো চারায় এ রোগ দেখা যায়। অনুমোদিত ছত্রাকনাশক আক্রমণের শুরুতেই প্রয়োগ করতে হবে।

গোয়ালগাদ্দা সীম সিলেট অঞ্চলের একটি জনপ্রিয় স্থানীয় জাতের সীম। সিলেটে মূলত গোলাপগঞ্জ এলাকায়ই এই সীমের আবাদ বেশি হয়ে থাকে,তবে সিলেট সদর, দক্ষিণ সুরমা, জৈন্তাপুর উপজেলায়ও এ শিমের আবাদ হয়।  বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এর চাষ বাড়াতে হবে। ফলে দেশে সবজির চাহিদা মিটিয়ে আরোও বেশি করে বিদেশে রপ্তানি করা যাবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে। পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।

 

- Advertisement -

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.