- Advertisement -

আউশে ফিরি, টেকসই কৃষি গড়ি

টেকসই কৃষি ব্যবস্থাপনায় রোপাআউশ ধান উৎপাদন একটা চমৎকার কৌশল।

1,240

- Advertisement -

 

আউশে ফিরি টেকসই কৃষি গড়ি

টেকসই কৃষি ব্যবস্থাপনায় রোপাআউশ ধান উৎপাদন একটা চমৎকার কৌশল। রোপা আউশ চাষ করলে ভূগর্ভস্থ পানির সুষম ব্যবহার, বিদ্যুৎ বা ডিজেলের সীমিত ব্যবহার, রাসায়নিক সারের পরিমিত ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে। অর্থ্যাৎ বোরো চাষ কমিয়ে রোপাআউশের আবাদ বৃদ্ধি করা, এতে কৃষির টেকসই ব্যবস্থা নিশ্চিতের পাশাপাশি উৎপাদন খরচও কমে যাবে। কৃষিতে শ্রমিক সংকট নিরাময়ে আউশ উৎপাদন একটি যুগান্তকারী ও কার্যকরী কৌশল হতে পারে।

মাঠ পর্যায়ে সরাসরি মাটি ও কৃষকের সাথে কাজ করি। আউশ উৎপাদনে কৃষকের কতগুলো সমস্যা ও সম্ভাবনার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। সেই বিষয়গুলো আলোচনায় এনেছি। বোরো ধানে খরচ বেশি, কষ্ট বেশি, শ্রমিক পাওয়া যায় না অত:পর পর্যাপ্ত দাম পাওয়া যায় না তারপরও কৃষক বোরো ছাড়ছে না কারণ বোরো ধান আবাদ করাটা খুবই সহজ বা অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। জমি ফাঁকা রেখে আউশ বা অন্যান্য ফসল চাষ করবে তার সাহস পায় না। খন্ডিত খন্ডিত জমি, পাশের জমিগুলোতে বোরো আবাদ হয়, এই কারণেও ইচ্ছে থাকার পরও অনেকে বোরো চাষ করতে বাধ্য। পক্ষান্তরে আউশ আবাদের প্রতি ভরসা কম। ভালো জাতের অভাব রয়েছে। গুণগতমানের বীজ তথা আউশের কোন বীজই বিএডিসি সরবরাহ করতে পারে না। বৃষ্টি নির্ভরশীলতা, মাঠে ধান কম থাকে বলে পোকার আক্রমন বেশি। সবচেয়ে বড় সমস্যা, মুক্ত বিচরণে অবাদে ঘুরতে থাকা গরু ছাগল। তাছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যার করাল গ্রাস। আরোও একটি বিষয়, গো খাদ্য হিসেবে কাচা ধান খড়ের ব্যাপক চাহিদা থাকা। কৃষকের তথ্য মতে, এক বিঘা জমিতে ধান হয় ১০-১২ মণ। ধানের মূল্য সর্ব্বোচ্চ ৫-৬ হাজার টাকা। অথচ গোখাদ্য হিসেব কাচা ধান গাছ বিক্রি করা যায় প্রায় ১০ হাজার টাকা। আউশ আবাদে এটাও একটা বড় সমস্যা বটে। তাছাড়া আউশ ধান কর্তন হয়, পুরো বর্ষার সময়, ধান শুকিয়ে সংরক্ষণ করাটাও একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ।

তারপরও আউশ আবাদকে আমরা উৎসাহিত করছি। যেসব বোরো এলাকায় দিনে দুবার বা প্রতিদিনই পানি দিতে হয় এমন এলাকাগুলোতে বোরো আবাদ নিরুৎসাহিত করছি। এসব এলাকায় ভুট্টা বা পাট বা আউশ আবাদে উৎসাহিত করছি। আউশ আবাদও ব্যাপক লাভজনক যেমন স্বল্প খরচে ও স্বল্প সময়ে ধান প্রাপ্তি, চালের গুণগতমান ভালো ও চাহিদা রয়েছে, শ্রমিক খরচ লাগে না বললেই চলে, কৃষি উপকরণ তথা সার, সেচ ও বালাইনাশক খরচ খুবই কম; তাছাড়া ধানের খড়গুলো বেশ দামে বিক্রি করার সুযোগ থাকে। এই জন্যই কৃষক ভাইদের আউশ আবাদে উৎসাহিত করছি। তবে আউশ আবাদে কৃষকদের কিছু কৌশল অনুসরণ করা উচিত। কৌশলগুলো হলো সমলেয় ও সমকালীন চাষাবাদ পদ্ধতি অনুসরণ করা, সঠিক জাত নির্বাচন, গুণগত বীজ সংগ্রহ, আদর্শ বীজতলা তৈরি, মূল জমি নির্বাচন ও জমি তৈরি, মাটি ও সার ব্যবস্থাপনা, পানি ব্যবস্থাপনা, রোগবালাই-পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা, ফসল কর্তন, সংগ্রহ ও সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা।

জাত নির্বাচন ও বীজতলা তৈরি: বন্যাপ্রবণ নিচু এলাকাতে আগাম জাতের আউশ ধান যথা ব্রি ধান২৬, ব্রি ধান২৭, ব্রি ধান৪৩এবং ব্রি ধান৪৮ চাষ করতে পারেন। তবে স্বল্প মেয়াদি জাত ব্রি ধান৪৮ ও বিনাধান ১৯ চাষ করতে পারেন। আদর্শ বীজতলায় হালিচারা উৎপাদন করতে হবে। ক্রান্তিকালীন সময়ে ব্রি ধান২৮ এবং বিনাধান ১৪ জাতের ধান আউশ মৌসুমে লাগানো সম্ভব।

চারার বয়স : রোপা আউশের চারা ২০-২৫ দিনের মধ্যে লাগাতে হবে। চারার বয়স বেশি হলে ফলন কম হয়। গবেষণায় দেখা যায়, একদিন বিলম্বে রোপণের কারণে বিঘা প্রতি ৭-৮ কেজি ফলন কম হয়।

চারা উঠানো ও পরিবহন : যত্নের সঙ্গে চারা উঠাতে হবে। টানা হেঁচড়া করে গোড়ার মাটি পরিষ্কার করলে অনেক সময় চারার গোড়া ভেঙে যায় ফলে রোপণের পর বাড় বাড়তি কম হয়। চারা পরিবহনের জন্য ঝুড়ি বা টুকরিতে সারি করে সাজিয়ে পরিবহন করা উচিত। বস্তাবন্দি করে ধানের চারা বহন না করাই উত্তম।

চারা রোপণ ও রোপণ দূরত্ব : রোপণের সময় জমিতে ছিপছিপে পানি থাকলেই চলে। অবশ্যই সারিতে চারা রোপণ করা উত্তম। এতে সব গাছ সমান আলো বাতাস ও পুষ্টি পায়। তাছাড়া পরিচর্যা করা সহজ হয়। প্রতি গুছিতে একটি সবল চারা রোপণ করাই যথেষ্ট। এ হারে রোপণ করলে এক বিঘা জমিতে ১.০-১.৫ কেজি বীজের চারা লাগে। প্রয়োজনে ২-৩টি পর্যন্ত চারা এক গুছিতে রোপণ করা যেতে পারে। তখন দ্বিগুণ হারে বীজের প্রয়োজন হবে। চারা সব সময় অল্প গভীরে (১ ইঞ্চি) রোপণ করা উত্তম। এতে কুশির সংখ্যা বাড়ে এবং চারার বৃদ্ধি ভালো হয়। রোপণ সময়, ফসলের জাত, জমির উর্বরতা, এসবের ওপর রোপণ দূরত্ব নির্ভর করে। তবে কমপক্ষে সারি-সারি ৮-১০ ইঞ্চি এবং গুছি গুছি ৬ ইঞ্চি রাখা দরকার।

মূল জমি নির্বাচন ও জমি তৈরি : রোপা আউশ ধানের জন্য মূল জমি ছায়ামুক্ত, মোটামুটি সমতল, সেচ সুবিধাযুক্ত এবং বন্যামুক্ত হতে হবে। বীজের জমির পাশে অন্য জাতের ধান আবাদ করতে হলে কমপক্ষে ১২-১৫ হাত দূরে করতে হবে। জমিতে আগাছা-খড়কুটা থাকলে ধান রোপণের ৩ সপ্তাহ আগে চাষ করা দরকার। সম্ভব হলে শতক প্রতি ২০ কেজি জৈব সার প্রয়োগ করুন। ১ম চাষ দেয়ার ৩-৫ দিন পর মই দিলে আগাছা, খড়-কুটা মাটির সঙ্গে মিশে যাবে। এ সময় জমির আইল সংস্কার করে পানি ধরে রাখুন। শেষ চাষে পাওয়ার টিলার বা গরুর লাঙল যেটাই ব্যবহার করুন জমি ৮-১০ ইঞ্চি গভীর করে চাষ দিতে হবে এবং মই দিয়ে জমি ভালোভাবে সমতল করতে হবে।

সার ব্যবস্থাপনা : পরিমিত পরিমাণে সুষম সার প্রয়োগ করুন। সম্ভব হলে মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে অনুমোদিত মাত্রায় সার প্রয়োগ করুন। সাধারণত এক বিঘা বা ৩৩ শতক জমিতে ২৩-২৪ কেজি ইউরিয়া, ৫-৬ কেজি টিএসপি, ৬-৭ কেজি এমওপি, ৪-৫ কেজি জিপসাম এবং ৬০০-৭০০ গ্রাম দস্তা সারের প্রয়োজন। মনে রাখবেন, জমির উর্বরতাভেদে সারের পরিমাণ কম বেশি হবে। ডিএপি সার প্রয়োগ করলে ২০% ইউরিয়া সার কম প্রয়োগ করুন।

আগাছা ব্যবস্থাপনা: চারা রোপণের ৪০ দিন পর্যন্ত জমি আগাছা মুক্ত রাখতে হবে। কমপক্ষে দু’বার আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। প্রথমবার রোপণের ১৫ দিন পর এবং পরের বার ৩০-৩৫ দিন পর।

বালাই ব্যবস্থাপনা : যদি বীজ, সার, পানি ও আগাছা ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করা হলে রোগ বালাইয়ের আক্রমণ কম হয়। সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার আলোকে বালাই দমন করতে হবে। রোগের মধ্যে বাদামি দাগ, ব্লাস্ট, খোল পোড়া, পাতা পোড়া, উফরা, বাকানি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ক্ষতিকর পোকার মধ্যে মাজরা, বাদামি গাছ ফড়িং, পাতা মোড়ানো, নলি মাছি, পাতা মাছি, গান্ধী পোকা, শিষকাটা লেদা পোকা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সাধারণ ব্যবস্থাপনা হিসেবে-নিয়মিত ফসল ক্ষেত জরিপ করতে হবে। ইউরিয়া সারের অতিরিক্ত ব্যবহার যেকোনো রোগ-পোকার আক্রমণ বাড়িয়ে দেয়। তাই পরিমিতি ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে। রোপণের সঙ্গে সঙ্গে জমিতে ধৈঞ্চার চারা বা ডালপালা পুঁতে দিতে হবে এতে পোকাখাদক পাখি শিকারের জন্য ক্ষেতে বসতে পারবে এবং ক্ষতিকর পোকা ধরে খাবে।

প্রিয় কৃষিজীবী ভাই ও বোনেরা, রোপা আউশ ধান উৎপাদন ব্যবস্থাপনাগুলো অত্যন্ত যত্ন সহকারে মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করা উচিত। এ বিষয়গুলো বিস্তারিত ও নতুন কিছু জানার জন্য আপনি আপনার নিকটতম উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা বা উপজেলা কৃষি অফিসে যোগাযোগ করে জেনে নিতে পারেন।

কৃষিবিদ মোহাইমিন

- Advertisement -

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.