- Advertisement -
ধানের ব্লাস্ট রোগ ও তার ব্যবস্থাপনা
ব্লাস্ট রোগ সম্পর্কে কৃষকের অভিমত, এই রোগটা হলো ধানের ক্যান্সার। কখন শুরু হয় আর কখন যে ধান ক্ষেত নষ্ট করে টের পাওয়া যায় না। শিষগুলো দাড়িয়ে থাকে। শিষ হেলে না। শিষে কোন চাল থাকে না। অসুস্থ ক্ষেতের খড়গুলোও নাকি গরু খায় না। অগ্রগামী কৃষকগণ মনে করেন, দিনে অসহ্য গরম আর চৈত্র বৈশাখ মাসে শেষ রাইতে লেপের ঠান্ডা লাগলেই রোগটার আক্রমন শুরু হয়, ইউরিয়া সার বেশি দিলে আর এমওপি সার কম ব্যবহার করলে নাকি রেহাই নাই। তাছাড়া অসুস্থ বীজ ব্যবহার করার ফলেও রোগটা হয়। ব্রি ধান২৮ এ ব্লাস্ট আক্রমন বেশি হয় তবে ব্রি ধান২৯ এ এর আক্রমন আছে। তাই তাদের ব্লাস্ট প্রতিরোধী জাত দরকার।
ধানে ব্লাস্ট হলে রক্ষা নাই। রোগটি মূলত ছত্রাকজনিত মারাত্নক ক্ষতিকর রোগ। বোরো ও আমন দুই মৌসুমেই ব্লাস্ট রোগ হয়ে থাকে। সাধারণত রোগটি ধানের যে কোন স্তরেই সংক্রমিত হতে পারে। আমাদের দেশে রোগটি মূলত পাতা, গিট ও নেক বা শিষের গোড়ায় আক্রমন করে।
পাতা ব্লাস্ট : আক্রান্ত পাতায় প্রথমে ছোট ছোট কালচে বাদামি দাগ দেখা যায়। সময়ের সাথে সাথে দাগগুলো বড় হতে থাকে। দাগের মাঝখানে ধুসর বা সাদা বর্ণ এবং কিনারার দিকে বাদামী বর্ণের রং ধারণ করে। দাগগুলো একটু লম্বাটে অনেকটা চোখের আকৃতির মতো হয়ে থাকে। পাশাপাশি থাকা দাগগুলো একত্রে মিশে গিয়ে পুরো পাতাটি শুকিয়ে মারা যায়।
গিট ব্লাস্ট : ধান গাছের গিটে আক্রান্ত হলে আক্রান্ত স্থানটি কালো বর্ণের ধারণ করে। গিটটি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। প্রবল বাতাসে গিটটি ভেঙ্গে ঝুলে থাকে।
নেক বা শিষ ব্লাস্ট: ধানের ডিগ পাতা ও শিষের গোড়ার সংযুক্ত স্থানে আক্রমন করে। শিশির বা গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির দানা উক্ত স্থানে জমা হওয়া শুরু হয়। জমে থাকা পানিতে ব্লাস্ট রোগের জীবাণু আক্রমন করে। আস্তে আস্তে আক্রান্ত স্থানটি পচে যায়। একপর্যায়ে শিষের সাথে গাছের পাতার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে পাতা থেকে শিষে খাবার যেতে বাধা সৃষ্টি হয়। অত:পর শিষ শুকিয়ে চিটা হয়ে যায়। দেরিতে আক্রমন করলে শিষটি ভেঙ্গে যেতে পারে।
রোগের অনুকূল পরিবেশ: দিনের বেলায় গরম (২৫-২৮ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড) ও রাতে ঠান্ডা (২০-২২ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড), সকালে শিশির পড়া, দিনে অধিক আদ্রর্তা (৮৫% বা তার বেশি), মেঘাচ্ছন্ন আকাশ, গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিপাত ও ঝড়ো আবহাওয়া এ রোগের জীবাণু আক্রমনের জন্য খুবই অনুকূলে।
ব্লাস্ট রোগের জীবাণূ বিস্তার: ব্লাস্ট রোগের জীবাণূ মূলত বাতাসের মাধ্যমেই বেশি ছড়ায়। তবে বীজের মাধ্যমেও এ রোগের জীবাণু ছড়ায়।
ব্লাস্টরোগ ব্যবস্থাপনা:
ব্লাস্ট রোগ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। নেক ব্লাস্ট রোগটি সবচেয়ে ভয়ংকর। অথচ এ রোগটি প্রাথমিকভাবে সনাক্ত করা যায় না, সনাক্ত হতে হতে ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়ে যায়। রোগ আক্রমনের পরে অনুমোদিত মাত্রায় ছত্রাকনাশক ব্যবহার করেও তেমন ভালো ফলাফল পাওয়া যায় না। তাই ব্লাস্ট রোগ প্রতিকারের আক্রমণের পূর্বেই ব্যবস্থা নেয়া উত্তম।
ব্লাস্ট রোগ আক্রমনের পূর্বে করণীয়
পর্যাপ্ত জৈব সার (বিঘা প্রতি ৫০০-৮০০ কেজি) ব্যবহার করা, সুষম মাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহার করা, জাতভেদে রাসায়নিক সার সঠিক মাত্রায় ব্যবহার নিশ্চিত করা (দীর্ঘমেয়াদি জাতের জন্য বিঘা প্রতি ইউরিয়া, টিএসপি/ডিএপি, এমওপি, জিপসাম ও দস্তা যথাক্রমে ৪০,১৩,২২,১৫, ও ১.৫ কেজি এবং স্বল্পমেয়াদি জাতের জন্য ৩৫,১২,২০,১৫ ও ১.৫ কেজি)। ডিএপি সার ব্যবহার করলে ইউরিয়া সার ০৫ কেজি কম ব্যবহার করলে চলে। ইউরিয়া সার তিন কিস্তিতে ব্যবহার নিশ্চিত করা, এমওপি সার দুই কিস্তি ব্যবহার নিশ্চিত করা, সুস্থ ও রোগমুক্ত ধানের জমি থেকে সংগৃহীত বীজ ব্যবহার করা।
অনুকূল আবহাওয়া বিরাজ করলেই বোরো ধানের ব্লাস্ট রোগ নিয়ন্ত্রণে শিষ বের হওয়ার আগ মুহূর্তে নাটিভো ৬ গ্রাম/ ট্রপার ৮ গ্রাম/দিফা ৮ গ্রাম/ব্লাস্টিন ৬ গ্রাম পরিমাণ ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে স্প্রে করে দিতে হবে। ০৫-০৭ দিন পর আরোও একবার স্প্রে করতে হবে।
ব্লাস্ট রোগ আক্রমনের পরে করণীয়
ব্লাস্ট রোগ আক্রমনের প্রাথমিক সময়ে জমিতে ১-২ ইঞ্চি পানি ধরে রাখতে হবে। পাতা ব্লাস্ট দেখা দেয়ার সাথে সাথে বিঘা প্রতি ০৫ কেজি হারে এমওপি সার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ব্লাস্ট রোগ আক্রমনের সাথে সাথেই নাটিভো ৬ গ্রাম/ ট্রপার ৮ গ্রাম/দিফা ৮ গ্রাম/ব্লাস্টিন ৬ গ্রাম পরিমাণ ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে স্প্রে করে দিতে হবে, ০৫-০৭ দিন পর আরোও একবার স্প্রে করতে হবে।
সর্বোপরি ব্লাস্ট নিয়ন্ত্রণে পূর্ব প্রস্তুতির প্রয়োজন। এ ব্যাপারে কৃষক ভাইদের সচেতনতাসহ দ্রুত ব্যবস্থা নেয়াই ব্লাস্ট রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
কৃষিবিদ মোহাইমিন
- Advertisement -
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.