- Advertisement -
জারা লেবুর চামড়ার একটি বিশেষ মিষ্টি গন্ধ রয়েছে। খোসা দিয়ে আচারও তৈরি করা হয়। বর্তমানে সিলেট অঞ্চলসহ বাংলাদেশের সব এলাকায় এ লেবুর ব্যাপক চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জারা লেবুর বাজার মূল্য বেশ চড়া, একেকটি লেবুর দাম ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
জলবায়ু ও মাটি : আর্দ্র ও উঁচু পাহাড়ি অঞ্চলে জারা লেবু ভালো জন্মে। প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এমন পাহাড়ি অঞ্চলের পানি নিষ্কাশনযুক্ত অম্লীয় মাটি এটি চাষের জন্য বেশি উপযোগী। মাটির অম্লত্ব ক্ষারত্ব মান ৫-৬ হলে ভালো হয়।
বংশ বিস্তার : বীজ (চারা) ও অঙ্গজ (কলম) দুইভাবে বংশ বিস্তার করা যায়। খুব ভালো মাতৃগুণ সম্পন্ন চারা পেতে কলমের চারা উত্তম। সাধারণত গুটি কলম দিয়ে বংশ বিস্তার করা হয়।
মাদা তৈরি : চারা বা কলম রোপণ করার ১৫-২০ দিন আগে ২.৫ মিটার থেকে ৩.৫ মিটার দূরত্বে ৬০ সেমি. দৈর্ঘ্য, ৬০ সেমি. প্রস্থ এবং ৬০ সেমি. গভীরতা বিশিষ্ট গর্ত তৈরি করতে হবে। গর্তের ওপরের মাটির সাথে ২০ কেজি জৈব সার, ২০০ গ্রাম টিএসপি, ২০০ গ্রাম এমওপি সার ভালোভাবে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করে দিতে হবে। প্রতি হেক্টর জমিতে ১১১১-১৬০০টি চারা রোপণ করা যায়।
রোপণ সময় : বর্ষাকাল চারা বা কলম লাগানোর উৎকৃষ্ট সময়। এক্ষেত্রে মে থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত চারা লাগানো যেতে পারে। তবে যদি সেচ সুবিধা থাকে তাহলে সারা বছরই চারা লাগানো যায়।
চারা/ কলম রোপণ ও পরিচর্যা :মাদা তৈরি করার ১৫-২০ দিন পর চারা বা কলম লাগাতে হয়। চারা বা কলম গর্তের ঠিক মাঝখানে খাঁড়াভাবে লাগাতে হবে এবং চারা বা কলমের চারদিকের মাটি হাত দিয়ে চেপে ভালোভাবে বসিয়ে দিতে হবে। চারার গোড়ায় ঝাঝরি দিয়ে পানি দিতে হবে। প্রয়োজনে প্রতিটি চারায় পৃথকভাবে বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
গাছে সার প্রয়োগ : চারা লাগানোর পর ভালো ফলন পেতে হলে নিয়মিতভাবে সময় মতো সার প্রয়োগ করতে হবে। মাটির বৈশিষ্ট্য, গাছের বয়সের ওপর সারের পরিমাণ ভিন্ন হয়ে থাকে। সাধারণত ১-২ বছর বয়সের গাছে ২০ কেজি পরিমান পচা গোবর, 200 গ্রাম ইউরিয়া, 200 গ্রাম টিএসপি, 200 গ্রাম এমওপি সার ব্যবহার করা যায়। ৩-৪ বছর বয়সের গাছে ২৫ কেজি পরিমান পচা গোবর, ৪০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৩০০ গ্রাম টিএসপি, ৩০০ গ্রাম এমওপি সার ব্যবহার করতে পারেন। ৬ বা তার চেয়ে বেশি বয়সের গাছে ৩০ কেজি পরিমান পচা গোবর, ৫০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৪০০গ্রাম টিএসপি, ৪০০ গ্রাম এমওপি সার ব্যবহার করা যায়।
সার প্রয়োগ পদ্ধতি : ছকে বর্ণিত সার তিন কিস্তিতে গাছের গোড়া হতে কিছু দূরে ছিটিয়ে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে বা চাষ দিয়ে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। পাহাড়ের ঢালে ডিবলিং পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। প্রথম কিস্তি বর্ষার প্রারম্ভে অর্থাৎ বৈশাখ – জ্যৈষ্ঠ মাসে এবং দ্বিতীয় কিস্তি মধ্য ভাদ্র থেকে মধ্য কার্তিক মাসে এবং তৃতীয় কিস্তি মাঘ-ফাল্গুন মাসে প্রয়োগ করতে হবে।
অঙ্গ ছাঁটাই : গাছের গোড়ার দিকে জল শোধক শাখা বের হলেই কেটে ফেলতে হবে। এছাড়া গাছের ভেতরের দিকে দুর্বল ডালপালা মধ্য কার্তিক (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) মাসে ছাঁটাই করে দিতে হবে। ডালপালা ছাঁটাই করার পর কর্তিত স্থানে বোর্দোপেস্টের প্রলেপ দিতে হবে যাতে ছত্রাক আক্রমণ করতে না পারে।
পানি সেচ ও নিষ্কাশন : খরা মৌসুমে ২-৩ বার সেচ প্রয়োগ করা দরকার। লেবু জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না তাই বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাতের সময় গাছের গোড়ার যাতে পানি না জমে সেজন্য নালা করে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
জারা লেবুর পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা
সিলেট অঞ্চলে লেবু ফসলে প্রায় ১৬ প্রজাতির পোকামাকড় আক্রমণ করে থাকে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো লেবুর প্রজাপতি পোকা, লিফ মাইনার, সাইলিড বাগ, থ্রিপস, ছাতরা পোকা, ছিদ্রকারী পোকা। এসব পোকামাকড় লেবু ফসলের ক্ষতিসাধন করে।
লেবুর প্রজাপতি পোকা : লেবুর প্রজাপতি পোকার কীড়া পাতার কিনারা থেকে খাওয়া শুরু করে। এ পোকা মূলত নার্সারিতে ও ছোট গাছে আক্রমণ করে। সাধারণত ফেব্রুয়ারি, জুলাই ও আগস্ট মাসে এ পোকার আক্রমণ বেশি হয়ে থাকে। প্রতিকার হিসেবে পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ করতে হবে। সম্ভব হলে ডিম ও কীড়াসহ পাতা সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। আলোক ফাঁদ দ্বারা পূর্ণাঙ্গ পোকা ধরে মেরে ফেলতে হবে।
লেবু পাতার ছোট সুড়ঙ্গকারী পোকা : লিফ মাইনার বা সুড়ঙ্গকারী পোকার কীড়াগুলো পাতার উপত্বকের ঠিক নিচের সবুজ অংশ খেয়ে আকা-বাঁকা সুড়ঙ্গের মতো সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে গাছের পাতার কিনারার দিক মুড়ে পুত্তলিতে পরিণত হয়। আক্রমণের মাত্রা তীব্র হলে গাছের পাতা কুঁকড়ে যায় ও বিবর্ণ হয়ে শুকিয়ে ঝড়ে পড়ে। আগস্ট ও অক্টোবর মাসে এ পোকার আক্রমণ বেশি হয়ে থাকে। প্রতিকার হিসেবে পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ করতে হবে। সম্ভব হলে ডিম ও কীড়াসহ পাতা সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
এসব পোকার আক্রমণ বেশি হলে কচি পাতায় স্পর্শ ও পাকস্থলী বিষ (সাইপারমেথ্রিন ১০ ইসি, ফেনিট্রোথিয়ন ৫০ ইসি) অথবা অন্তর্বাহী বা প্রবাহমান বিষ (ডাইমেথয়েট ৪০ ইসি, কার্বোসালফান ২০ ইসি) জাতীয় কীটনাশক ২ মিলি/লিটার পানি বা ১ গ্রাম/লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ১০-১৫ দিন পরপর ৩-৪ বার গাছে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে।
জারা লেবুর অন্যান্য সমস্যা
লাল পিঁপড়া: লাল পিঁপড়া কয়েকটি পাতা একত্র করে বাসা তৈরি করে। এতে গাছের পাতা নষ্ট হয়ে যায় এবং সালোক সংশ্লেষণ ব্যাহত হয়। এসব বাসায় মিলিবাগ আক্রমণ করে, ফলে গাছে সুটিমোল্ড রোগের প্রাদুর্ভাব হয়। গাছ থেকে পিঁপড়ার বাসা অপসারণ করতে হবে। প্রয়োজনে সেভিন ৮৫ এসপি ২ মিলি/লিটার পানি বা ডারসবান ২০ ইসি ২ মিলি/লিটার পানিতে মিশিয়ে পিঁপড়ার বাসায় প্রয়োগ করতে হবে।
লাল মাকড় : লাল মাকড় লেবুজাতীয় ফলের কচিপাতা ও ফলে আক্রমণ করে। এদের আক্রমণে পাতার নিচের দিক বাদামি বর্ণ ধারণ করে। পাতা কুঁকড়ে যায় ও গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। আক্রমণের প্রথম দিকে আক্রান্ত পাতা সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। যেকোন মাকড়নাশক যেমন ভারটিম্যাক বা ওমাইট ৫৭ ইসি ১.৫ মিলি. প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে গাছে স্প্রে করতে হবে।
জারা লেবুর রোগ ব্যবস্থাপনা
ক্যাঙ্কার : এটি একটি ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগ। কচি পাতা, বাড়ন্ত কুঁড়ি, পাতা ও ফলে এ রোগের আক্রমণ বেশি হয়। আক্রান্ত পাতার উভয় পাশে খসখসে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। ক্ষত অংশের চারদিকে গোলাকার হলুদ কিনারা দেখা যায়। পাতা হলুদ হয়ে ঝরে পড়ে এবং আক্রান্ত ডগা ওপর দিক থেকে মরতে থাকে। ফলের ওপর আক্রমণ বেশি হলে ফল ফেটে যায় ও ঝরে পড়ে। রোগের প্রাদুর্ভাব প্রকট হলে কুপ্রাভিট ৮০ ডব্লিউপি (কপার অক্সিক্লোরাইড) প্রতি লিটার পানিতে ৭ গ্রাম হারে ১০-১৫ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে। বোর্দো মিশ্রণ (১০০ গ্রাম তুঁতে ও ১০০ গ্রাম চুন ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে) ৭-১০ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে।
স্ক্যাব : লেবুর চামড়ার ওপর ছোট ছোট বাদামি বা লালচে বাদামি দাগ দেখা যায়। এ দাগগুলো দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে খসখসে হয়ে যায় যা দেখতে অনেকটা দাদ রোগের মত মনে হয়। কিছু কিছু দাগ গভীর হয় আবার কিছু কিছু দাগ বাহিরের দিকে খাঁড়া থাকে। এ রোগ ব্যবস্থাপনায় ম্যানকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২.০ গ্রাম হারে ১০-১৫ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে।
- Advertisement -