- Advertisement -

ডেফল সমাচার

অপ্রচলিত ফল

0 776

- Advertisement -

 

ডেফল সমাচার

ডেফল খেতে এতই টক যে, প্রাচীন বচনেও তার সরব উপস্থিতি রয়েছে যথা “ডেওয়া ডেফল, অতি চুকা নারিকেল” অর্থ্যাৎ ডেফল ডেওয়া খাওয়ার পর মিষ্টি নারিকেলও টক লাগে। ডেফল, বহু প্রাচীন এবং বাংলাদেশে অপ্রচলিত ফলের তালিকায় তার স্থান।  আমাদের দেশে বানিজ্যিকভাবে ডেফল চাষাবাদ করা হয় না। কালে ভদ্রে কিছু সৌখিন মানুষ ডেফল গাছ লাগিয়ে থাকেন। ডেফল গাছ সাধারণত বনে জঙ্গলে, বন বাদাড়ে, ঝোপ ঝাড়, অগভীর বন, টিলা, পাহাড়ে প্রাকৃতিকভাবেই জন্মে, বড় হয়, ফল হয় এবং বিস্তার ঘটে।

ডেফল গাছের পরিচিতি ও বিস্তার

ডেফল ঘন সবুজ পাতা বিশিষ্ট সপুষ্পক গাছ। ডেফল দেখতে অনেকটা ডাম্বেল আকৃতির হয়ে থাকে। চাকমা ভাষায় একে ডেমগোলা নামে ডাকা হয় আবার গারো সংস্কৃতিতে আরুয়াক নামে বিশেষ পরিচিত। ডেফলের আকার আকৃতি অনেকাংশে ডিমের মতো দেখতে বিধায় একে এগ ফ্রুট নামেও ডাকা হয়। আবার বনে বাদরে বানরের আহার বস্তু হওয়ায় এর নাম মাংকি ফ্রুট। তবে ইংরেজিতে একে ফলস ম্যাংগোস্টিন এমনকি ইয়েলো ম্যাংগোস্টিন নামেও ডাকা হয়ে থাকে। ডেফলের বৈজ্ঞানিক নাম এধৎপরহরধ ীধহঃযড়পযুসঁং, যা ঈষঁংরধপবধব পরিবারের সদস্য। গাছটির আদি নিবাস মালয়েশিয়া আবার অনেকেই উত্তর ভারতে এর আদিস্থান দাবি করেন। বিশ্বব্যাপী ‘এধৎপরহরধ’ গণভুক্ত প্রায় ১৪০ টি প্রজাতি রয়েছে। একটা সময় বাংলাদেশের সিলেট, ময়মনসিংহ, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বনাঞ্চলে ডেফল গাছ ব্যাপকভাবে দেখা যেত। বর্তমানে জঙ্গলের ফল গাছ নামে খ্যাত ডেফল শুধুই মাত্র সিলেট ও পার্বত্য এলাকায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। ডেফল গাছের পরিমানও আশংকাতীতভাবে কমে যাচ্ছে। তবে ক্রান্তীয় এবং উপক্রান্তীয় অঞ্চলে সহজেই এই গাছ জন্মে থাকে। রোদেলা ও ছায়াময় উভয় জায়গাতেই এই গাছের বেড়ে উঠা বড়ই স্বাচ্ছন্দময়। এ গাছের অন্যতম বড় একটি গুণ হলো অনাবৃষ্টি তথা খরাসহনশীল গাছ। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশেই (দক্ষিন চীন, ভারতীয় উপমহাদেশ, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম) ডেফল চাষ করা হয়।

ডেফলের ব্যবহার, পুষ্টিমান ও ঔষধি গুণাগুণ

পাকা ডেফল অত্যন্ত টক। এটি দিয়ে জ্যাম, জেলি, আচার, জুস, সস, চাটনি, টক ডাল এবং তরকারি তৈরি করা হয়। ফলের ভেতর চার-পাঁচটি দানা থাকে। দানার সাথে রসালো ভক্ষণ অংশ থাকে, যা চুষে খাওয়া যায়। কাঁচা ফল খেলে দাঁতে হলদেটে কষ লেগে যায়। সিলেটের বাজারে কাঁচা ডেফল বিক্রি হয়। সিলেটে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি খাবার ট্যাঙ্গা বা টক রান্নায় এটি ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া ডাল ও অন্যান্য নানাবিধ তরকারি রান্নায়ও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কাচা ডেফল ফালি ফালি করে কেটে শুকিয়ে আমসুল তৈরি করা হয়, যা পরবর্তীতে লবন, মরিচের গুড়া মিশিয়ে মুখরোচক লোভনীয় চাটনি তৈরি হয়। জঙ্গলে বানর ও অন্যান্য পশু-পাখিরাও ডেফল খেয়ে থাকে। ডেফল গাছে পার্পল-ম্যাঙ্গোস্টিনের (এধৎপরহরধ সধহমড়ংঃধহধ) কলম দেওয়া যায়। এভাবে একই গাছে ডেফল ও ম্যাঙ্গোস্টিন উভয় ফল উৎপাদন করা যায়। শুকনো ডেফল ফলের নির্যাসকে মধসনড়মব বলা হয়। যা থেকে জলরং বানানো হয়। ডেফলের ভেষজ গুণও রয়েছে। ডেফল থেকে ীধহঃযড়হব নামক রাসায়নিক পদার্থ সংগ্রহ করা যায়, যার মধ্যে এন্টিবায়োটিক এবং এন্টি-ম্যালেরিয়াল গুণ আছে বলে ধারণা করা হয়। ভেষজ চিকিৎসায় এর অনেক ব্যবহার হয়ে থাকে।

ডেফলে প্রচুর পুষ্টি উপাদান রয়েছে। মুখের রুচি বাড়াতে এবং জ্বরের জন্য বেশ কার্যকরী। ভিটামিন সি’তে পূর্ণ এই ফলটি সর্দিজ্বর ও ঠান্ডা প্রশমনে বেশ উপকারী। এছাড়া এটি অরুচি দূর করতে সহায়তা করে। পরিপক্ক ফল বায়ুনাশক ও পিত্তদোষ কমায়। কাঁচা ফল থেতলিয়ে গরম পানির সাথে খেলে দান্ত কমে যায় এবং মেদ ভুড়ি কমায়। প্রতি ১০০ গ্রাম ডেফলে ১.৩ গ্রাম খনিজ উপাদান, ১.০ গ্রাম হজমযুক্ত আশ, ৭৪ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি, ১.১ গ্রাম আমিষ, ১৪.৯ গ্রাম শর্করা, ০.৭ গ্রাম চর্বি, ১৩৩ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ২.১ মিলিগ্রাম লৌহ, ৪২.৯ মিলিগ্রাম ক্যারোটিন, ১৮.০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি এবং সামান্য পরিমান ভিটামিন বি১ ও ভিটামিন বি২ পাওয়া যায়। ডেফলে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক উপাদান যেমন জ্যান্থোকাইমল, আইসোজ্যান্থোকাইমল, ক্যাম্বোজিন, ভলক্যানসিফ্লাবোন, মরিল্লোাফ্লাবোন, বাইফ্লাবোন জিবি-১ ও জিবি-১এ, ম্যাক্লোরিন, ১,৫-ডাইহাইড্রোক্সিজ্যান্থোন, ১,৭-ডাইহাইড্রোক্সিজ্যান্থোন এসব পাওয়া যায়।

ডেফল গাছের বৈশিষ্ট্য

গাঢ় সবুজ পাতাবিশিষ্ট ডেফল গাছ মাঝারি আকৃতির হয়ে থাকে । সাধারণত এ গাছটি লম্বায় প্রায় ১৩ থেকে ২৩ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। এ গাছের পাতার রং উজ্জ্বল সবুজ, চকচকে, লম্বাটে বল্লমাকার, কিনারার দিকে খাঁজকাটা খাঁজকাটা ও অগ্রভাগ সূঁচের ন্যায় এবং লম্বায় প্রায় ২০-২৪ সেমি । এর ফুলের রং সাদা বর্ণের হয়ে থাকে। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় মার্চ থেকে মে মাসে ফুল ফোটে। ফলগুলো মাঝারি আকৃতির আপেলের সমান, লম্বায় প্রায় ৮-১০ সেমি পর্যন্ত হয়ে থাকে। ফলটি মসৃণ, অগ্রভাগ সূঁচালো এবং কিছুটা বাঁকানো; কাঁচা অবস্থায় গাঢ় সবুজ এবং পাকলে গাঢ় হলুদ রঙের হয়। পাকা হলুদ বর্ণের ফলটি দেখতে অসম্ভব সুন্দর লাগে। শীতকালে গাছে যখন পাতা ঝরে যায়। ডেফল মূলত শীতকালে পাকে। এই ফলের শাঁস সুগন্ধযুক্ত ও রসালো। ভেতরে এক বা একাধিক বীজ থাকে। ফলের স্বাদ টক-মিষ্টি। ডেফল গাছে প্রচুর ফল হয়ে থাকে। ফলরত অবস্থায় বিশেষ করে পাকা ফল অবস্থায় গাছটি দেখতে দারুণ সুন্দর লাগে।

ডেফল গাছ লাগানোর কলাকৌশল

বাংলাদেশে এখনো ডেফলের অনুমোদিত জাত বের হয় নাই। স্থানীয় জাত হিসেবে প্রাপ্ত ডেফল গাছটি বেলে দোআঁশ থেকে পলি দোআঁশ মাটি বেশি পছন্দ করে। সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চলের নিকাশ যুক্ত অম্লীয় মাটি ডেফল উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী। বহুবর্ষজীবি ডেফল গাছ উঁচু, সরাসরি রৌদ্রযুক্ত ও সুনিকাশযুক্ত এবং পানির উৎসের কাছাকাছি জায়গায় রোপণ করলে ভাল হয়। তবে ডেফল গাছের অন্যতম ভালো একটি গুণ হলো ইহা খরাসহনশীল। প্রথমেই সুস্থ, সবল, রোগমুক্ত চারা বা গুটি কলম নির্বাচন করতে হবে। সরকারি নার্সারী বা বিশ্বস্থ নার্সারি হতে চারা সংগ্রহ করা ভাল। চারা রোপণের ১৫ থেকে ২০ দিন আগেই উভয় দিকে ৬ থেকে ৬ মিটার দূরত্বে ১০০ সেমি প্রস্থে, ১০০ সেমি লম্বায় এবং ১০০ সেমি গভীর করে গর্ত তৈরি করতে হয়। প্রতি গর্তে প্রায় ১৫ কেজি পরিমাণ পঁচা গোবর, ৩ থেকে ৫ কেজি পরিমাণ ছাই, ৯০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০০ গ্রাম টিএসপি, ১০০০ গ্রাম এমওপি, ৫০ গ্রাম জিপসাম, ১০ গ্রাম দস্তা, ১০ গ্রাম বোরণ এবং ২৫০ গ্রাম চুন গর্তের উপরের মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করে পানি দিতে হয়। গর্ত ভর্তি করার ১০ থেকে ১৫ দিন পর গর্তের মাঝখানে ১ বছর বয়সের নির্ধারিত চারাটি সোজাভাবে লাগিয়ে গোড়ার মাটি সামান্য চেপে দিতে হয় এবং লাগানোর পরপরই খুঁটি ও পানি দেয়ার ব্যবস্থা করতে হয়। মূলত মধ্য জৈষ্ঠ থেকে মধ্য শ্রাবণ মাস ডেফলের চারা রোপণের উপযুক্ত সময়।

সার প্রয়োগ:

গাছের যথাযথ বৃদ্ধির জন্য সময়মত, সঠিক পরিমাণে এবং সঠিক পদ্ধতিতে সার প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে সারের পরিমাণ বাড়াতে হবে। বয়সভেদে গাছ প্রতি সারের পরিমাণ নিচে দেওয়া হল:
গাছের বয়স (বছর)                   গোবর সার (কেজি)           ইউরিয়া (গ্রাম)          টিএসপি (গ্রাম)              এমওপি (গ্রাম)
১-২                                             ৫-১০                       ২০০-৩০০               ২০০-৩০০                    ২০০-৩০০
৩-৪                                            ১০-১৫                     ৩০০-৪৫০               ৩০০-৪৫০                    ৩০০-৪৫০
৫-১০                                          ২০-২৫                    ৪৫০-৬০০              ৪৫০-৬০০                     ৪৫০-৬০০
১০-১৫                                        ২৫-৩০                    ৬০০-৭৫০              ৬০০-৭৫০                    ৬০০-৭৫০
১৫ এর অধিক                               ৩০-৪০                      ১০০০                      ১০০০                              ১০০০

উল্লিখিত পরিমাণ সার প্রতি বছর সমান তিন কিস্তিতে বর্ষার আগে ও বর্ষার পওে এবং শীতের পওে গাছে প্রয়োগ করতে হবে। গাছের ডালপালা যে পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে তার নিচের জমি কোদাল দিয়ে হালকা করে কুপিয়ে সার প্রয়োগ করতে হবে। সাধারণত গাছের গোড়ার একমিটার এলাকায় কোন সক্রিয় শিকড় থাকেনা, তাই সার প্রয়োগের সময় গাছের গোড়ায় সার প্রয়োগ করা উচিত নয়। ভূমিক্ষয় রোধ করার জন্য পাহাড়ী অঞ্চলে ডিবলিং পদ্ধতিতে সার প্রয়োগ করা যেতে পারে।

আগাছা দমন:

গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য জমিতে আগাছামুক্ত রাখা দরকার। বর্ষার শুরুতে ও বর্ষার শেষে হালকাভাবে কোদাল দ্বারা কুপিয়ে বা চাষ দিয়ে আগাছা দমনের ব্যবস্থা করতে হয়।

পানি সেচ ও নিষ্কাশন:

যদিও ডেফল গাছ খরাসহনশীল তারপরও প্রয়োজনবোধে বয়স্ক গাছে খরা মৌসুমে ২ থেকে ৩ টি সেচ দিলে ডেফলের ফলন ও গুণগত মান বৃদ্ধি পায়। গাছের গোড়ায় পানি জমলে মাটি বাহিত রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায় । তাই অতিরিক্ত পানি নালার মাধ্যমে নিষ্কাশন করে দিতে হয়।

অঙ্গছাঁটাই

অঙ্গ ছাঁটাই ফলগাছ তথা ডেফল গাছের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থাপনা। এতে গাছের আকার, আকৃতি যেমন সুন্দর হয় তেমনি ফলনও বেশি হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে চারা রোপণের দুবছরের মধ্যে পার্শ্বশাখা কেটে দেয়া, চিকন, নরম, রোগা বা দুর্বল শাখা সিকেচার দিয়ে নিয়মিত কেটে রাখলে গাছ বালাইমুক্ত থাকে ও ফলন বেশি হয়। তাছাড়া ফল সংগ্রহের শেষে ফলের বোটা, ছোট শাখা-প্রশাখা ও মরা ডালপালা কেটে দিলে পরের মৌসুমে নতুন শাখা প্রশাখা জন্মায়। এতে গাছ নীরোগ থাকে, ফলনও বেশি হয়।

ফলসংগ্রহ

পরিপক্ক অবস্থায় ফলের রং হলুদে হয়। তাই ফল হলুদ হওয়ার সাথে সাথেই গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করতে হয়।
অনেকে ডেফলকে ডেওয়া বা কাউফলের সাথে গুলিয়ে ফেলতে পারেন। তবে ডেফল, ডেওয়া এমনকি কাউফল প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্ন ফল। ডেফল কিন্তু দিনের ফলও নয়। তাছাড়া একটু অন্যভাবে চিন্তা করলে দেখা যায়, ফলের আগে ডে বসিয়ে হয়ে গেল ডেফল, তাও কিন্তু সঠিক নয়। বিষয়টা যদি এমন করে ভাবি, ডে মানে দিন ফল মানে ফল ফলাদি অর্থ্যাৎ দিনফলাদি। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, প্রত্যেক মানুষের প্রতিদিনই একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ফল খাওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আর তারই রুপক বহি:প্রকাশ মাত্র ছাড়া কিছুই নয়।

ডেফল একটি দেশীয় অপ্রচলিত ফল। কথায় আছে খাদ্য, পুষ্টি ও অর্থ চাই; দেশি ফলেই গাছ লাগাই। চলুন আমরা প্রত্যেকে একটি করে ডেফল গাছ লাগাই।

 

- Advertisement -

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.