- Advertisement -
সবজি চাষী নূরুল আহমদ এর গল্প
ছোটবেলায় বাবার কাছেই কৃষি কাজে হাতেখড়ি। অন্যান্য অনেক সিলেটবাসীর মতো জীবিকার তাগিদে একদিন পাড়ি জমান ভিনদেশের মাটিতে। কিন্তু কোন কাজেই যেন মন বসে না। ভিনদেশে কৃষি কাজের অগ্রগতি ও নানাবিধ কৃষি প্রযুক্তি দেখে একদিন তার মনে হলো এই আধুনিক প্রযুক্তিগুলো দেশের মাটিতে নিজেও প্রয়োগ করতে পারেন। অত:পর দেশে ফিরে আসেন। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া জমিগুলোতে সবজি আবাদ করা শুরু করেন। আধুনিক প্রযুক্তিভিত্তিক উপায়ে সবজি আবাদ করতে গিয়ে তিনি শরনাপন্ন হন উপজেলা কৃষি অফিসের। পরবর্তীতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, বিভিন্ন এনজিও এদের কল্যাণে প্রশিক্ষিত হয়ে আজ একজন সফল সবজি চাষী। নিজেই সবজি চাষের প্রতি আবদ্ধ না থেকে উৎসাহিত করেছেন অন্যান্য কৃষকদের। বর্তমানে তিনি তার অনুসারী প্রায় ৬২০ জন সবজি চাষী কৃষকদের নিয়ে একটি সংগঠন সৃষ্টি করেছেন। সবজি উৎপাদনে বৈচিত্র্য এনেছেন। এলাকাকে সবজি চাষে সমৃদ্ধ করেছেন। সিলেট সদর উপজেলার হাটখোলা ইউনিয়নের নোয়াগাও গ্রামের কৃষক মো. নূরুল আহমদ।
জনাব মো. নূরুল আহমদ, নোয়াগাও, শিবেরবাজার, হাটখোলা, সিলেট সদর, সিলেট এর একজন সফল সবজি চাষী। তিনি মূলত আগাম শীতকালীন টমেটো, বছরব্যাপী বরবটি, শসা, বেগুন এসব উচ্চ মূল্যের সবজি ফসল আবাদ করেন। গত ১৯৯২-৯৩ সাল থেকে সবজি চাষ করে আসছেন। শুরুতে প্রায় ১৫ একর জমি থাকলেও ভাইদের সাথে জমি ভাগাভাগির পর বর্তমানে ০৫ একর জমিতে সবজি আবাদ করেন। বিদেশের মাটিতে কৃষি ভিত্তিক বিভিন্ন আধুনিক কার্যক্রমের প্রতি উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশে এসে সেসব প্রযুক্তি ব্যবহারে আত্ননিয়োগ করেন। আধুনিক প্রযুক্তিগুলো রপ্ত করার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ ইন্সটিটিউট এবং বিভিন্ন বেসরকারি দপ্তর থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে মনোনিবেশ করেন সবজি উৎপাদনে। গত ২০১৫ সালে প্রায় ১৪ লাখ টাকা নিট আয় করেন।
মো. নূরুল আহমদ সবজি চাষে লাভবান হওয়ার মূল রহস্য-
১. তিনি প্রচুর পরিমাণে কম্পোস্ট বা গোবর সার ব্যবহার করেন। নিজের গোয়াল ঘর থেকে সংগ্রহের পাশাপাশি বাহির হতে গোবর কিনে কম্পোস্ট সার তৈরি করেন। অসময়ে গোবর কিনে রাখেন এতে দাম কম লাগে এবং প্রাপ্তিতে সমস্যা হয় না। তাছাড়া সময় বুঝে কুইক কম্পোস্ট নিজ হাতে তৈরি করে সবজি ক্ষেতে ব্যবহার করেন।
২. তিনি সবজি ক্ষেতে বিশেষ পদ্ধতিতে স্থায়ী মাঁচা তৈরি করা। জিআই তার ও লাইলনের সুতা দিয়ে বাঁশের খুটি ভালোভাবে শক্ত করে স্থায়ী মাঁচা তৈরি করেন। যা তিন বা চার বছর পর্যন্ত কাজে লাগান। এই মাঁচা সবজি উৎপাদনের খরচ বিশেষ ভাবে কমিয়ে দেয়। ফলে তিনি সহজেই লাভবান হন।
৩. সময় উপযোগী সবজি আবাদ করা। সবজি ফসলের চাহিদা ও বাজার দরকে মাথায় রেখে তিনি সবজি নির্বাচন করেন। যেমন ২০১৬ সাল (এবছর) রমজান মাসকে সামনে রেখে রমজান মাসের প্রায় ৫০ দিন আগে শসার বীজ রোপণ করেন। এমন জাতের শসার বীজ রোপণ করেন যা ৪৫ থেকে ৫০ দিনে ফলন দেয়া শুরু করে। সেই মোতাবেক রমজান মাসের প্রথম দিন থেকেই তিনি শসা বিক্রি করা শুরু করেন। কৃষি তথ্য সার্ভিস, সিলেট এর সাথে সাক্ষাতকারের দিনই তিনি প্রায় ২০০০ কেজি শসা বিক্রি করেছেন। প্রতি কেজি শসা প্রায় ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছেন।
৪. সবজি সংগ্রহের পর সংগ্রত্তোর পরবর্তী পরিচর্যাগুলো সঠিকভাবে মেনে চলেন। সবজি সংগ্রহ করার সময় কাচি ও ক্রেট ব্যবহার করেন। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় তিনি সবজি আড়তে পৌঁছানোর ব্যবস্থা নিজেই করেন। ফলে মধ্যসত্ত্বভোগীরা কোন সুযোগ নিতে পারেন না। এতে তিনি বাজারের পুরো দামই পান এবং সহজেই লাভবান হন।
৫. সবজি উৎপাদনে বালাইনাশক ব্যবহারের তিনি যথেষ্ট কৃপণ। অযাচিত উপায়ে বালাইনাশক ব্যবহার করেন না। সঠিক সময়ে নিয়ম মোতাবেক সুনির্দিষ্ট মাত্রায় সঠিক বালাইনাশক ব্যবহার করেন। বালাইনাশক ব্যবহারে তিনি যথেষ্ট বিবেচক।
৬. তিনি গতানুগতিক সবজি চাষাবাদ করেন না। অর্থ্যাৎ সমসাময়িক ফসলের উৎপাদনের সময় তিনি অন্যদের সাথে গা ভাসিয়ে দেন না। সব সময় কিছু না কিছু ব্যতিক্রম কাজ করেন। যেমন এপ্রিল মাসের আগাম বন্যার হাত থেকে শসার চাষাবাদ নিশ্চিত করতে মূল জমির পাশাপাশি উঁচু নিরাপদ জায়গায় কিছু চারা আলাদাভাবে উৎপাদন করেন। ফলে এপ্রিল মাসের আগাম বন্যায় মূল জমিতে থাকা শসার চারা মারা গেলেও পরবর্তীতে পানি নামার সাথে সাথে মজুদ থাকা শসার চারা লাগিয়ে দিয়ে শসা উৎপাদন করা শুরু করেন। এতে করে সময় মতই শসা উৎপাদন করতে পেরেছেন। অসময়ে শসার উৎপাদনে বাজারে দামই প্রচুর পেয়েছেন।
৭. সবজির বীজ নির্বাচনের ব্যাপারে অধিক সাবধান থাকেন। পরিচিত ও বিশ্বস্ত জায়গা থেকে সবজির বীজ সংগ্রহ করেন। সবজি উৎপাদনে অবশ্যই বীজ শোধন করেন। বীজতলার মাটি শোধন করেন। সবজির চারার বিশেষ যতœ নেন। বীজ উৎপাদন যথা দেশীয় শিম যেমন গোয়ালাগাদ্দা শিমের বীজ উৎপাদন করেন। সিলেটের বাজারে উনার উৎপাদিত বীজ ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
৮. নিয়মিত মাটি পরীক্ষা করে সবজি ক্ষেতে রাসায়নিক সার ব্যবহার করেন। তাছাড়া ডলোচুন ব্যবহার করেন। কম্পোস্ট সার ব্যবহার করেন।
নিজে সবজি চাষের পাশাপাশি এলাকার অনেক কৃষকদের সবজি উৎপাদনে উৎসাহিত করেন। মটিভেশনের মাধ্যমে প্রায় ৬২০ জন কৃষককে সবজি চাষের প্রতি উৎসাহিত করেন। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন, কৃষকের পায়ের ধুলা জমির জন্য সার। তাই তিনি জমি ও জমির ফসলের নিয়মিত পরিচর্যা নেন। বিদেশের মাটিতে হাড়ভাঙ্গা কঠিন পরিশ্রম করে টাকা আয় করার চেয়ে স্বদেশের মাটিতে পরিকল্পিত উপায়ে সবজি উৎপাদনে অনেক বেশি লাভবান হওয়া যায় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই মো. নূরুল আহমদ।
- Advertisement -