- Advertisement -

হাত পরাগায়ন: লাউ ও কুমড়া উৎপাদন বৃদ্ধির কৌশল

কৃত্রিম পরাগায়ন

3,322

- Advertisement -

 

হাত পরাগায়ন: লাউ ও কুমড়া উৎপাদন বৃদ্ধির কৌশল

কৃষিবিদ মোহাইমিনুর রশিদ

ফল ফসল উৎপাদনের মূলশর্ত হলো অনুকুল পরিবেশে সফল পরাগায়ন ও গর্ভধারণ। ফুলের পরাগরেণু স্ত্রী কেশরের গর্ভমুন্ডে স্থাপিত হলে তাকে পরাগায়ন বলা হয়ে থাকে। এই রেণু গর্ভমুন্ড থেকে গর্ভদন্ডের মধ্যে এক ধরনের কৈশিক বা সরু নলের মাধ্যমে গর্ভাশয়ে পৌঁছে এবং সেখানে ডিম্বানুর সাথে নিষিক্তকরণের মাধ্যমে ফল ও বীজ গঠন শুরু করে। তাই প্রায় সব ধরণের ফলের উৎপাদনে পরাগায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই পরাগায়ন প্রধানতঃ দু’ভাবে হতে পারে- প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম। অধিকাংশ গাছেই প্রাকৃতিকভাবে পোকা-মাকড়, বাতাস এসবের মাধ্যমে পরাগায়ন ঘটে থাকে। কিছু কিছু গাছ আছে তাদের প্রাকৃতিক পরাগায়নের উপর নির্ভর করলে ফলন কম হয়। সে ক্ষেত্রে তাদের পরাগয়ন কৃত্রিমভাবে ঘটাতে হয়। তাছাড়া বিভিন্ন ফসল উৎপাদনে যথেচ্ছ ভাবে কীটনাশক ব্যবহারের ফলে পরাগায়নকারী পোকা-মাকড় আশংকাজনকভাবে জমি থেকে কমে যাচ্ছে। এর কারণে যেসব ফসলের ফল গঠন প্রাকৃতিক নিয়মে স্বাভাবিকভাবে হত এখন তা বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে। তাই অনেক ফসলেই এখন কৃত্রিম পরাগায়ন ঘটানো জরুরী প্রয়োজন হয়ে পড়ছে। শাক-সবজিসহ অন্যান্য সব ফসলের বেলায় পরাগায়ন একটি অনিবার্য বিষয়। সবজির মধ্যে কুমড়া জাতীয় যেসব সবজি রয়েছে যেমন- মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, লাউ, তরমুজ, করলা, কাঁকরোল, পটল এসব ফসলের ফলন বৃদ্ধির জন্য কৃত্রিম পরাগায়ন জরুরী হয়ে দাড়িয়েছে। বিশেষ করে মিষ্টিকুমড়া, লাউ, তরমুজ, কাঁকরোল, চালকুমড়া-এর ক্ষেত্রে কৃত্রিম পরাগায়ন না ঘটালে ফলন মারাত্নকভাবে কমে যায়। অনেক সময় দেখা যায় গাছে ফুল ফুটছে প্রচুর: লাউ বা কুমড়ার কড়াও রয়েছে ফুলের গোড়ায় অথচ ফুল ফোটার দু’একদিন পরেই কড়াগুলো শুকিয়ে বা পচে ঝরে যায়। এর মুল কারণ হলো স্ত্রী ফুলে পরাগ যোগ না হওয়া। এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে হলে এবং প্রতিটি স্ত্রী ফুল থেকে একটি করে ফল পেতে হলে কৃত্রিম পরাগায় ঘটাতে হবে। তবেই আমরা কাংখিত ফলন আশা করতে পারি অর্থাৎ ফলন ৯০ ভাগ পর্যন্ত আশা করা যায়।

কৃত্রিম পরাগায়ন ঘটাতে হলে প্রথমে পুরুষ ও স্ত্রী ফুল চেনা দরকার। ফুলের চরিত্র বিচারে ও যৌন বিকাশের ক্ষেত্রে মিষ্টিকুমড়া ও লাউ জাতীয় সবজির প্রায় গাছগুলো সহবাসী অর্থাৎ একই গাছে স্ত্রী ও পুরুষ ফুল ফোটে। অধিকাংশ ফুল একলিঙ্গী তাই একই ফুলের মধ্যে স্ব-পরাগায়ন ঘটার কোন সম্ভাবনা থাকে না। সাধারণভাবে যেসব ফুলের বোঁটায় ফলের একটি আকৃতি থাকে যাকে গর্ভাশয় বলা হয় সেসব ফুলই স্ত্রী। আর যেসব ফুলের গোড়ায় কোন গর্ভাশয় বা এ ধরনের কোন গঠন থাকেনা সেগুলি পুরুষ ফুল। কুমড়া এবং লাউয়ের পুরুষ ফুল লম্বা বোঁটায় এককভাবে ফোটে। স্ত্রী ফুলের বোঁটা থাকে খাটো এবং এরাও এককভাবে ফোটে। সাধারণতঃ পুরুষ ও স্ত্রী ফুল গাছের একই গিঁটে বা পত্রকক্ষে ফোটে না। কুমড়া জাতীয় সবজি গাছের বয়স সাধারণতঃ ৪০-৪৫ দিন হলে ফুল ফোটা শুরু করে। আবহাওয়ার উপর ভিত্তি করে এই সময়ের তারতম্য ঘটে থাকে। একটি গাছে স্ত্রী ফুলের চেয়ে পুরুষ ফুল বেশি ফোটে। স্ত্রী ফুলের সংখ্যা যত বাড়ে ফলন ও তত বাড়ে। তবে পুরুষ ও স্ত্রী ফুলের সংখ্যার বাড়া এবং কমা পারিপার্শ্বিকতার উপর অনেকটা নির্ভর করে। যেমন- যে জমিতে বেশি পরিমাণে ইউরিয়া ব্যবহার করা হবে এবং তাপমাত্রা ও দিনের দৈর্ঘ্য বেশি হবে সে জমিতে পুরুষ ফুল বেশি ফোটে। অন্যদিকে এর বিপরীত পরিবেশে স্ত্রী ফুল বেশি ফুটে থাকে। বিশেষ করে লাউ এবং তরমুজের বেলায় এ ঘটনা দেখা যায়।

কৃত্রিম পরাগায়ন-
পরপরাগায়নের মাধ্যমে কুমড়া জাতীয় সবজির পরাগায়ন ঘটে থাকে। প্রাকৃতিক উপায়ে পরপরাগায়নের উপর নির্ভর করা হলে বিশেষ করে কুমড়া ও লাউ ফসলের ফলন কম হয়। এজন্য পুরুষ ফুলের পরাগরেণু সংগ্রহ করে বা পুরুষ ফুল দিয়ে স্ত্রী ফুলের গর্ভমুন্ডে ছোঁয়াতে বা ঘষতে হয়। এটাই কৃত্রিম পরাগায়ন। কুমড়া জাতীয় সবজির কৃত্রিম পরাগায়নের জন্য কয়েকটি বিষয়ের দিকে নজর রাখতে হয়। প্রথমতঃ পুরুষ ও স্ত্রী ফুল ফোটার সময়। কুমড়া জাতীয় সবজির সব প্রজাতির ফুল ফোটার সময় এক নয়। ফুল ফোটা, পরাগবিদারণ,গর্ভাধান ও ফলধারণ পরিবেশগত উপাদানগুলি সবচে বেশি প্রভাবিত করে। কুমড়া জাতীয় সবজির ফুল সকালেই ফোটে। লাউ এর ফুল দুপুর পর্যন্ত ফোটে ও ফলধারণ ঘটে। কাজেই কৃত্রিম পরাগায়নের জন্য উপযুক্ত সময় ও ফুল বেছে নিতে হবে যে সময়ে পরাগায়ন এবং গর্ভাধারন কার্যকরী হয়। এজন্য একই সময়ে ফোটা স্ত্রী ও পুরুষ ফুল বেছে নেয়া ভালো। একই সময়ে ফোটা স্ত্রী ও পুরুষ ফুল না হলে পরাগরেণুর সজিবতা ও গর্ভমুন্ডের পরাগগ্রহীতা সমান হয় না এর জন্য ফলধারণ বিঘ্নিত হয়। কুমড়ার কৃত্রিম পরাগায়ন করতে হলে সাধারণতঃ সকাল বেলায় একই সময়ে ফোটা পুরুষ ও স্ত্রী ফুল বেছে নিতে হয়। ভোরে এ কাজ করা ভাল। পুরুষ ফুলটি গাছ থেকে বোঁটাসহ ছিড়ে তার পাঁপড়ি ফেলে দিতে হবে। এ অবস্থায় বোঁটার উপর শুধু পরাগদন্ডটি দাঁড়িয়ে থাকে। কাজগুলি করার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন পরাগদন্ডের মাথায় যে পরাগধানী ও হলুদ গুঁড়ো গুঁড়ো পরাগরেণু থাকে তা যেন নষ্ট না হয় এবং কোন ঘষা না লাগে। এবার পুংদন্ডটি হাতে নিয়ে স্ত্রী ফুলের গর্ভমুন্ডে ঘষে দিতে হবে। এতে গর্ভমুন্ডের আঠালো পদার্থে পরাগ রেনু লেগে যাবে। পরাগায়নের অসংখ্য পরাগরেণুর মধ্যে একটি সক্রিয় পরাগরেণুই ফলধারণের জন্য যথেষ্ট। একটি পুরুষ লাউ ফুল দিয়ে সাধারণ ৫-৬ টি স্ত্রী ফুলের পরাগায়ন করা ভাল এবং একটি পুরুষ কুমড়া ফুল দিয়ে সাধারণ ৮-১০টি স্ত্রী ফুলের পরাগায়ন করা ভাল। পুরুষ ফুল ছিড়ে সাথে সাথেই পরাগায়ন ঘটানো ভাল। মিষ্টি কুমড়ার বেলায় সকালের দিকে এবং লাউয়ের বেলায় সকাল ১০টার দিকে পরাগায়নের কাজ করা ভাল। রোদ বেশি হলে অনেক সময় গর্ভমুন্ডের আঠালো পদার্থ শুকিয়ে পরাগগ্রহিতা হারাতে পারে এবং পরাগরেণুর সজীবতা কমে যেতে পারে এজন্য কম তাপমাত্রা ও রোদ কড়া হওয়ার আগে কৃত্রিম পরাগায়ন ঘটানো ভাল। কুমড়া জাতীয় সবজির স্ত্রী ফুলে সাধারণতঃ তিনটি গর্ভপত্র থাকায় গর্ভমুন্ডটি তিন খাঁজবিশিষ্ট হয়। তাই পরাগধানী আলতোভাবে ঘষতে হবে। যাতে পরাগরেণুর তিনটি অংশেই সমানভাবে লাগে। অধিকাংশ প্রজাতির স্ত্রী ফুলে গর্ভমুন্ডের পরাগগ্রাহিতা দুপুর পর্যন্ত থাকে তবু সার্থক ফলধারণের জন্য উপযুক্ত সময়ে সঠিক পরিমাণে পরাগরেণু সংযোগ ঘটানো উচিৎ। তা’না হলে ফলের আকার আকৃতি ছোট ও বিকৃত হতে পারে। পরাগায়ণের সকল নিয়ম কানুন মেনে সঠিকভাবে কৃত্রিম পরাগায়ন ঘটাতে পারলে কুমড়া জাতীয় সবজির ফলন বহুগুণে বাড়ানো সম্ভব।

 

- Advertisement -

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.