- Advertisement -
রোপা আমন ধানের উৎপাদন ব্যবস্থাপনা
কৃষিবিদ মোহাইমিন
রোপা আমন ধান উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় যে কৌশলগুলো রয়েছে তা হলো গুণগত বীজ সংগ্রহ, সঠিক জাত নির্বাচন, আদর্শ বীজতলা তৈরি, মূল জমি নির্বাচন ও জমি তৈরি, মাটি ও সার ব্যবস্থাপনা, পানি ব্যবস্থাপনা, রোগবালাই-পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা, ফসল কর্তন, সংগ্রহ ও সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা। আজ উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা করা হলো।
মূল জমি নির্বাচন ও জমি তৈরি : রোপা আমন ধানের জন্য মাঝারি থেকে উর্বর জমি উত্তম। মূল জমি ছায়ামুক্ত, মোটামুটি সমতল, সেচ সুবিধাযুক্ত এবং বন্যামুক্ত হতে হবে। বীজের জমির পাশে অন্য জাতের ধান আবাদ করতে হলে কমপক্ষে ১২-১৫ হাত দূরে করতে হবে। জমিতে আগাছা-খড়কুটা থাকলে ধান রোপণের ৩ সপ্তাহ আগে চাষ করা দরকার। সম্ভব হলে শতক প্রতি ২০ কেজি জৈব সার প্রয়োগ করুন। ১ম চাষ দেয়ার ৩-৫ দিন পর মই দিরে আগাছা, খড়-কুটা মাটির সঙ্গে মিশে যাবে। এ সময় জমির আইল সংস্কার করে পানি ধরে রাখুন। শেষ চাষে পাওয়ার টিলার বা গরুর লাঙল যেটাই ব্যবহার করুন জমি ৮-১০ ইঞ্চি গভীর করে চাষ দিতে হবে এবং মই দিয়ে জমি ভালোভাবে সমতল করতে হবে।
সার ব্যবস্থাপনা : পরিমিত পরিমাণে সুষম সার প্রয়োগ করুন। এজন্য সম্ভব হলে মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে অথবা সংশ্লিষ্ট কৃষি বিভাগের সহায়তায় কৃষি পরিবেশ অঞ্চল অনুযায়ী অনুমোদিত মাত্রায় সার প্রয়োগ করুন। সাধারণত এক বিঘা বা ৩৩ শতক জমিতে ২৩-২৪ কেজি ইউরিয়া, ৫-৬ কেজি টিএসপি, ৬-৭ কেজি এমওপি, ৪-৫ কেজি জিপসাম এবং ৬০০-৭০০ গ্রাম দস্তা সারের প্রয়োজন। মনে রাখবেন, জমির উর্বরতাভেদে সারের পরিমাণ কম বেশি হবে। প্রতি ১০০ কেজি পঁচা গোবর সারে ১ কেজি ইউরিয়া, ৭৫০ গ্রাম টিএসপি এবং ১ কেজি এমওপি সার পাওয়া যায়। কাজেই রাসায়নিক সার প্রয়োগের ক্ষেত্রে অনুমোদিত মাত্রা থেকে জৈব সার থেকে প্রাপ্ত বিয়োগ দিয়ে বাকিটুকু প্রয়োগ করতে হবে। ডিএপি সার প্রয়োগ করলে ২০% ইউরিয়া সার কম প্রয়োগ করুন। বোরো মৌসুমে দস্তা প্রয়োগ হলে এ সার দেয়ার প্রয়োজন নেই। ইউরিয়ার তিন ভাগের এক ভাগ এবং অন্যান্য সারের সবটুকু শেষ চাষের সময় ছিটিয়ে দিন। তবে হালকা বুনটের মাটিতে এমওপি সার দুই কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। তিন ভাগের দুই ভাগ জমি তৈরির সময় এবং এক তৃতীয়াংশ কাইচ থোড় আসার ৫-৭ দিন আগে প্রয়োগ করুন। গুঁড়া ইউরিয়া সার এলসিসি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রয়োগ করুন অথবা প্রচলিত পদ্ধতিতে তিন কিস্তিতে প্রয়োগ করুন। ১ম কিস্তি শেষ চাষের সময়, ২য় কিস্তি চারা রোপণের ৭-১০ দিন পর এবং ৩য় কিস্তি কাইচ থোর আসার ৫-৭ দিন আগে প্রয়োগ করুন। গুটি ইউরিয়া প্রয়োগের ক্ষেত্রে চারা রোপণের ৭-১০ দিনের মধ্যে প্রতি চার গোছার মাঝখানে ২-৩ ইঞ্চি কাঁদার গভীরে ১.৮ গ্রাম সাইজের গুটি পুঁতে দিতে হবে। জমিতে গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ করলে সব সময়ই এক থেকে দেড় ইঞ্চি পানি ধরে রাখতে হবে। তবে হালকা বুনটের মাটি অর্থাৎ যে মাটির পানি ধারণক্ষমতা খুবই কম সে মাটিতে গুটি ইউরিয়া ব্যবহার করা যাবে না। এলসিসি ও গুটি ইউরিয়া উভয় পদ্ধতিতে ইউরিয়া সাশ্রয় হয় এবং ফলন বাড়ে। পরীক্ষায় দেখা গেছে, গুটি ইউরিয়া প্রয়োগে গাছের সুপ্ত ক্ষুধা থাকে না বিধায় ফলন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। আর বীজ ফসলের জমিতে কখনই অতিরিক্ত ইউরয়া ব্যবহার করা যাবে না কেননা অতিরিক্ত ইউরিয়ার কারণে রোগ-বালাইয়ের আক্রমণ বেড়ে যায় এবং বীজের গুণগতমান বিনষ্ট করে ফেলে।
চারার বয়স : চারার বয়স ২৫-৩০ দিন হলে খুবই ভাল হয়। তবে স্বল্প মেয়াদি জাতের ক্ষেত্রে ২০-২৫ দিনের চারা রোপণ করা উচিত। চারার বয়স বেশি হওয়ার কারণে ফলনের ওপর সরাসরি প্রভাব পড়ে। গবেষণায় দেখা যায়, একদিন বিলম্বে রোপণের কারণে বিঘা প্রতি ৭-৮ কেজি ফলন কম হয়। নিচু জমিতে রোপণ বিলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে দোগোছা বা বলান করা অর্থাৎ বীজতলা থেকে চারা উত্তোলন করে মূল জমিতে রোপণের পূর্বে অন্য জমিতে ঘন করে চারা রোপণ করা হয়। পরে পানি নেমে গেলে মূল জমিতে চারা রোপণ করা যায়।
চারা উঠানো : চারা উঠানোর আগে বেশি করে পানি দিয়ে বীজতলা ভিজিয়ে দিতে হবে যাতে মাটি নরম হয়। যত্নের সঙ্গে চারা উঠাতে হবে। টানা হেঁচড়া করে গোড়ার মাটি পরিষ্কার করলে অনেক সময় চারার গোড়া ভেঙে যায় ফলে রোপণের পর বাড় বাড়তি কম হয়। তাই চারা উঠানোর সময় এসব বিষয় খেয়াল রাখা দরকার।
চারা পরিবহন : বীজতলা থেকে রোপণের জন্য চারা বহন করার সময় পাতা ও মোড়ানো পরিহার করতে হবে। এজন্য ঝুড়ি বা টুকরিতে সারি করে সাজিয়ে পরিবহন করা উচিত। বস্তাবন্দি করে ধানের চারা কোনক্রমেই বহন করা যাবে না।
চারা রোপণ ও রোপণ দূরত্ব : রোপণের সময় জমিতে ছিপছিপে পানি থাকলেই চলে। সারিতে চারা রোপণ করা উত্তম। এতে সব গাছ সমান আলো বাতাস ও পুষ্টি পায়। পরিচর্যা করা সহজ হয়। প্রতি গুছিতে একটি সবল চারা রোপণ করাই যথেষ্ট। এ হারে রোপণ করলে এক বিঘা জমিতে ১-১.৫ কেজি বীজের চারা লাগে। প্রয়োজনে ২-৩টি পর্যন্ত চারা এক গুছিতে রোপণ করা যেতে পারে। তখন দ্বিগুণ হারে বীজের প্রয়োজন হবে। চারা সব সময় অল্প গভীরে (১ ইঞ্চি) রোপণ করা উত্তম। এতে কুশির সংখ্যা বাড়ে এবং চারার বৃদ্ধি ভালো হয়। রোপণ সময়, ফসলের জাত, জমির উর্বরতা, এসবের ওপর রোপণ দূরত্ব নির্ভর করে। তবে কমপক্ষে সারি-সারি ৮-১০ ইঞ্চি এবং গুছি গুছি ৬ ইঞ্চি রাখা দরকার। বীজ প্লটে প্রতি ৮ সারি পর ১ সারি ফাঁকা রাখতে হবে। ওই ফাঁকা স্থান দিয়ে ক্ষেতের ভেতর আন্তপরিচর্যা করতে সুবিধা হয় এবং বাদামি গাছ ফড়িং বা কারেন্ট পোকা আক্রমণ প্রবণ এলাকার জন্য এটি কার্যকর পদ্ধতি।
চারার বিকল্প : অনেক সময় জলাবদ্ধতা, বন্যা বা অন্য কোন প্রাকৃতিক কারণে ফসল নষ্ট হয়ে যায়। তখন পার্শ্ববর্তী ফসলি জমি কিংবা যেখানে ধান নষ্ট হয়নি সেখান থেকে কুশি তুলে অন্যত্র রোপণ করা যায়। এতে মূল জমিরে ফসলের কোন ঘাটতি হয় না। প্রতিটি গোছা থেকে ২-৩ টি কুশি তুলে লাগানো যেতে পারে।
আগাছা ব্যবস্থাপনা : চারা রোপণের ৪০ দিন পর্যন্ত জমি আগাছা মুক্ত রাখতে হবে। কমপক্ষে দু’বার আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। প্রথমবার রোপণের ১৫ দিন পর এবং পরের বার ৩০-৩৫ দিন পর। উঠানো আগাছা যেখানে-সেখানে না ফেলে মাটির নিচে পুঁতে দিলে তা পচে গিয়ে জৈব সারের কাজ করে।
সেচ ব্যবস্থাপনা : প্রথমেই আমাদের মনে রাখতে হবে ধান গাছ জলজ উদ্ভিদ নয়। তবে শারীরবৃত্তীয় চাহিদা জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ পানির প্রয়োজন। যদিও আমন মৌসুম সেচ নির্ভর নয় তবুও ধান গাছের বৃদ্ধির বিভিন্ন পর্যায়ে কী পরিমাণ পানির চাহিদা থাকে তা জেনে রাখা ভালো। চারা লাগানোর সময় ছিপছিপে থেকে সর্বোচ্চ ১ ইঞ্চি, চারা লাগানো থেকে পরবর্তী ১০ দিন পর্যন্ত ১.৫-২ ইঞ্চি, চারা লাগানোর ১১ দিন পর থেকে থোড় আসা পর্যন্ত ১-১.৫ ইাঞ্চি, কাইচ থোড় হওয়ার সময় থেকে ফুল ফোটা পর্যন্ত ২-৩ ইঞ্চি এবং ধান কাটার ১০-১২ দিন আগে পর্যায়ক্রমে পানি বের করে দিতে হবে। এ মৌসুমে খরা দেখা দিলে সম্পূরক সেচের ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য বোরো মৌসুমে তৈরি করা নালা ভেঙে দেয়া যাবে না অথবা ফিতা পাইপের ব্যবস্থা করে রাখতে হবে।
বালাই ব্যবস্থাপনা : ফসল ক্ষেতে রোগ-বালাই থাকবে এটাই স্বাভাবিক তবে তা অর্থনৈতিক ক্ষতির সীমা অতিক্রম করছে কিনা তা জানতে হবে। যদি বীজ, সার, পানি ও আগাছা ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করা হলে রোগ বালাইয়ের আক্রমণ কম হয়। সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার আলোকে বালাই দমন করতে হবে। রোগের মধ্যে বাদামি দাগ, ব্লাস্ট, খোল পোড়া, পাতা পোড়া, উফরা, বাকানি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ক্ষতিকর পোকার মধ্যে মাজরা, বাদামি গাছ ফড়িং, পাতা মোড়ানো, নলি মাছি, পাতা মাছি, গান্ধী পোকা, শিষকাটা লেদা পোকা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সাধারণ ব্যবস্থাপনা হিসেবে- নিয়মিত ফসল ক্ষেত জরিপ করতে হবে। চীন দেশীয় প্রবাদ আছে কৃষকের পায়ের ধুলা জমির সার। ফসল জমি পর্যবেক্ষণ করে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। ইউরিয়া সারের অতিরিক্ত ব্যবহার যেকোনো রোগ-পোকার আক্রমণ বাড়িয়ে দেয়। তাই পরিমিতি ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে। রোপণের সঙ্গে সঙ্গে জমিতে ধৈঞ্চার চারা বা ডালপালা পুঁতে দিতে হবে এতে পোকাখাদক পাখি শিকারের জন্য ক্ষেতে বসতে পারবে এবং ক্ষতিকর পোকা ধরে খাবে।
আপনার ব্লকের উপসহকারি কৃষি অফিসারের পরার্মশ নিন। প্রয়োজনে উপজেলা কৃষি অফিসে যোগাযোগ করেন।
- Advertisement -
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.