- Advertisement -
মাঘ মাসের কৃষি
কৃষিবিদ মোহাইমিনুর রশিদ
কথায় আছে মাঘের শীত বাঘের গায়ে লাগে। কুয়াশামাখা শীতের বাস্তবতায় শিশির ভেজা ভোর, দুপুরের মিষ্টি রোদ আর বিকেল গড়িয়ে সন্ধায় আবার সেই কুয়াশার চাঁদর, হাড় কাঁপানো হিমেল হাওয়া এসবই মাঘ মাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ সময়ে প্রাকৃতিক দূর্যোগ থাকেনা বললেই চলে। উৎপাদিত ফসলে যেমন স্বাদ তেমনি আমাদের রসনা তৃপ্তিতেও আলাদা রসের মাত্রা যোগ করে। কৃষির পথ চলায় পরতে পরতে আমাদের কি করতে হবে তা আমরা সংক্ষেপে জেনে নেই।
প্রথমেই বোরো ধানের যত্ন পরিচর্যার কথা- এখন মাঠে বোরো ধানের বাড়ন্ত পর্যায়। যেহেতু বাড়ন্ত পর্যায় তাই প্রয়োজন ইউরিয়া সারের উপরি প্রয়োগ, নিয়মিত সেচ প্রদান, আগাছা দমন, বালাই ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য পরিচর্য। বোরো ধানের বাড়ন্ত সময়ে ইউরিয়া পরিমাণমত প্রয়োগ করা হলে কুশির সংখ্যা বাড়ে, গাছ পুষ্ট হয় এবং পরবর্তীতে ধানের শীষে দানার সংখ্যা বাড়ে, ধান পুষ্ট হয় এবং ওজন বাড়ে। সে হিসেবে ফলনও বেশি হয়।
ধান রোপণের ১৫-২০ দিন পর প্রথম কিস্তি, ৩০-৪০ দিন পর দ্বিতীয় কিসিবত এবং ৫০-৫৫ দিন পর শেষ কিস্তি হিসেবে ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। জাতভেদে এবং জমির উর্বরতা ভেদে সারের মাত্রা ভিন্ন হয়। সারের উপরি প্রয়োগের আগে জমির আগাছা অবশ্যই পরিস্কার করতে হবে এবং জমির পানি কমিয়ে নিতে হবে। ভালো ফলনের জন্য নিয়মিত পানি সেচের কোন বিকল্প নেই। চারা রোপণের সময় ছিপছিপে পানি, কুশি বের হবার সময় এবং কাইছ থোড় আসার সময় ৫-১০ সে.মি পানি ক্ষেতে রাখতে হবে।
এসময় ধান ক্ষেতে রোগ ও পোকার আক্রমণ দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে বাদামী গাছ ফড়িং, পামরী পোকা এবং খোলপোড়া, পাতা পোড়া, টুংরো এসব রোগের আক্রমণ দেখা দিতে পারে। রোগ ও পোকা থেকে ফসলকে রক্ষা করতে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা বা আইপিএম পদ্ধতির বিকল্প নোই। এক্ষেত্রে পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ, আন্তঃপরিচর্যা, যান্ত্রিক দমন, উপকারী পোকা সংরক্ষণ, ধানের জমিতে ডাল-পালা পঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে ধানক্ষেতকে বালাইমুক্ত করতে হবে। রোগ ও পোকার আক্রমণ বেশি হলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মোতাবেক শেষ উপায় হিসেবে কীটনাশক বা বালাইনাশক সঠিক মাত্রায় সঠিক নিয়মে প্রয়োগ করতে হবে।
এখন হয়ত আপনার জমির গমে শীষ বের হওয়ার সময় হয়েছে। এ অবস্থায় গম গাছের বয়স যদি ৫৫-৬০ দিন হয় সম্ভব হলে একটি সেচ দিতে পারেন। সেচ দেয়ার পর জমিতে জো আসলে মাটির উপরের চটা ভেঙ্গে দিতে হবে। এ সময় গম ক্ষেতে ইঁদুরের উপদ্রব দেখা দিতে পারে। সমন্বিতভাবে ইঁদুরের আক্রমন প্রতিহত করতে হবে তা নাহলে গমের ফলন অনেক কমে যাবে। জমিতে ইঁদুরের আক্রমণ দেখা দিলে গর্ত খুঁড়ে, জমির আইল পরিস্কার করে, গর্তে পানি ঢেলে, ধোঁয়া দিয়ে, ফাঁদ পেতে বা রাসায়নিকভাবে অর্থাৎ যে কোন উপায়েই হউক ইঁদুর দমন করতে হবে। প্রাকৃতিকভাবে বিড়াল, গুইসাপ, বেজি, পেচা এসব প্রাণীদের সংরক্ষণ করে ইঁদুর দমন করা যায়। এসময়ে আপনার ভূট্টার জমির মাটির সাথে প্রয়োজনীয় ইউরিয়া সার ভালো করে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে। প্রয়োজনে সেচ দিতে হবে, গাছের নিচের দিকের মরা পাতা ভেঙ্গে দিতে হবে। যদি ভূট্টার সাথে সাথী বা মিশ্র ফসলের চাষ করে থাকেন তবে সময়মত সেগুলোর প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করতে হবে।
এই শীতে বাহারি সব্জির বর্ণিল রঙে চারদিক একাকার। নিয়মিত পরিচর্যা করতে পারলে শীত মৌসুমে শাকসব্জির বেশি ফলন পাওয়া যাবে। নাবিতে রোপন করা ফুলকপি, টমেটো, বেগুন, বাঁধাকপি, গাজর, লাউ, শিম, কুমড়া এসব ফসলের জমির আগাছা পরিস্কার, মাটি তুলে দেয়া, সেচ দেয়া, মাটির আস্তর ভেঙ্গে দেয়া, সারের উপরি প্রয়োগ, বালাই ব্যবস্থাপনা, সময়মত ফসল কাটাসহ অন্যান্য কাজগুলো সময়মত করতে হবে। মনে রাখতে হবে পরিকল্পিতভাবে কৃষি কাজ করতে পারলে উৎপাদন খরচ কম হবে লাভ বেশি হবে। আপনি যদি টমেটো সংরক্ষণ করতে চান তবে আধাপাকা টমেটোসহ টমেটো গাছ তুলে ঘরের ঠান্ডা জায়গায় উপুড় করে ঝুলিয়ে পাতলা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখলে পরবর্তীতে অনেক দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করে রেখে খাওয়া যায়।
মেঘলা আবহাওয়ায় আলুর নাবী ধসা রোগ বা লেটব্লাইট রেগের আক্রমণ দেখা দিতে পারে। আক্রমণ বেশি হলে ফলন একেবারে নাও হতে পারে। সেজন্য ডায়থেন এম-৪৫, রিডোমিল, ম্যানকোজেব বা এ জাতীয় অন্য কোন উপযুক্ত ছত্রাকনাশক অনুমোদিত মাত্রায় জমিতে ভালোভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে। এছাড়াও আলুর জমিতে নিয়মিত সেচ, মালচিং, আগাছা পরিস্কার, পোকা-মাকড় ও রোগবালাই নিয়ন্ত্রণ সঠিকমত করতে হবে। তবেই অধিক ফলন আশা করা যাবে। আলু গাছের বয়স ৯০ দিন হলে মাটির সমান করে গাছ কেটে দিন এবং ১০ দিন পর আলু তুলে নিন। এতে আলুর ফলন বাড়ে, আলুর চামড়া মোটা হয়, আদ্রতা কমে আসে। আলু তোলার পর ভালো করে পরিস্কার করে শুকিয়ে বাছাই করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। ছায়াযুক্ত ঠান্ডা স্থানে আলু সংরক্ষণ করতে হবে। বালুর মধ্যে আলু সংরক্ষণ করা হলে ৪-৭ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করে রাখা যায়।
মাঠে এখন তেল ও ডাল জাতীয় ফসলের পাকার সময়। খাদ্য, পুষ্টি ও অর্থনীতিতে তেল এবং ডাল ফসলের গুরুত্ব অনেক। পাকার সময় হলে তা সংগ্রহের ব্যবস্থা করতে হবে। তেল জাতীয় ফসল শতকরা ৮০ ভাগ পাকলেই সংগ্রহ করতে হবে। ডাল ফসল সংগ্রহের সময় গাছের গোড়াসহ না উঠিয়ে মাটি থেকে কয়েক ইঞ্চি উপরে কাটতে হবে। কারণ ডাল ফসলের শিকড়ে নাইট্রেজেরে গুঁটি থাকে যা ইউরিয়া সারের কাজে লাগে। এসব গুঁটি মাটিতে থাকলে মাটির উর্বরতা বাড়ে।
শীতকালে আপনার গবাদিপ্রাণির যত্ন নিন। শীতের হাত থেকে আপনার গরু-বাছুরকে রক্ষা করতে চট দিয়ে ঢেকে দিন। মাঠে এখন অনেক তাজা ঘাস রয়েছে। নিয়ম মেনে খাওয়ালে গবাদিপ্রাণি মোটাতাজা হবে, অতিরিক্ত ও বেশি লাভের যোগান দিতে হলে গবাদিপশু মোটাতাজার কোন বিকল্প নেই। আপনার গবাদি পশুর টিকা, কৃমির ওষুধ, খুরা, তরকা, গলাফুলা বা অন্যান্য রোগের আক্রমণ লক্ষণ সম্পর্কে সবসময় সচেতন থাকতে হবে। হাঁস মুরগির বেলায়ও রানীক্ষেত, কলেরা এসব রোগের আক্রমণ দেখা দিতে পারে। নিজে চিকিৎসা না করে একজন প্রাণি চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
শীতকালে মাছের বাড়বাড়তি কম হয়। শীতে মাছের ক্ষতরোগ দেখা দিতে পারে। এসবের কারণে এসময়ে পুকুরে মাছের যতœ পরিচর্যা বেশি করতে হবে। পুকুরে মাছের প্রয়েজনে চুন সার সম্পূরক খাবার এসব পরিমাণমত দিতে হবে। এজন্য একজন মৎস্যবিদ বা অভিজ্ঞ মাছ চাষির পরামর্শ মোতাবেক মাছ চাষ করা হলে অধিক লাভবান হবেন।
- Advertisement -
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.