- Advertisement -
বোরো ধান সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা
কৃষিবিদ মোহাইমিন
বৈশাখ মাস বোরো ধান কাটার মোক্ষম সময়। ধানের শিষে শতকরা ৮০ ভাগ ধান সোনালী আভায় পরিণত হলেই ধান কাটার উপযুক্ত সময়। বোরো ধানের সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনাগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটা ধাপ রয়েছে। ধাপগুলো হলো সময়মতো ধান কাটা, দ্রুত মাড়াই, ঝাড়াই, শুকানো এবং উপযুক্ত জায়গায় সংরক্ষন বা গুদামজাত করা। ধান সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনাগুলোর প্রতিটা ধাপেই অত্যন্ত যতœ সহকারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হয়। রোদ্রোজ্জ্বল দিনে অনুকূল আবহাওয়ায় ধান কাটা উচিত। এতে ধানের অপচয় কম হয় ও গুণগতমান বজায় থাকে। বীজ ধানের জন্য অধিকতর গুরুত্ব দিতে হয়। সংগ্রহোত্তরকালে ধানের গুণগতমানের অবনতি রোধ করার জন্য ধানের সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি জানা অবশ্যই দরকার।
ধান কাটা
ধান ক্ষেত সোনালী হলুদ থেকে ধান গাছ শুকিয়ে হলুদ হয়ে গেলেই বুঝতে হবে ধান পেকেছে। তবে ধানের জাতভেদে ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। সব জাতের বেলায় পাতা হলুদ নাও হতে পারে। গবেষকরা বলেন, শিষে শতকরা ৮০ ভাগ ধান পেকে সোনালি হলুদ হলেই ধান কাটা যায়। তবে ধান পেকেছে কিনা তা ভালভাবে নিশ্চিত হতে হলে একটি শিষ বা ছড়া নিয়ে সুনিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়। সাধারণত শিষের মাথার দিক থেকে ধান পাকতে শুরু করে। শিষের মাথা থেকে কয়েকটি ধান নিয়ে খোসা ছাড়িয়ে পরীক্ষা করে যদি দেখা যায় চাল শক্ত ও স্বচ্ছ তাহলে বুঝতে হবে ধান পেকেছে। চাল নরম থাকলে সে ধান ভালভাবে পাকেনি। তাছাড়া শিষের নিচের অংশের শতকরা ২০ ভাগ চাল যদি আংশিক শক্ত কিন্তু স্বচ্ছ আবার উক্ত শিষের মাথায় শতকরা ৮০ ভাগ চাল শক্ত ও স্বচ্ছ দেখা যায় তাহলে ধান ঠিকমত পেকেছে বলে ধরে নেয়া যায়। আটি বাধা, নাড়াচাড়া করা ও স্থানান্তরের সময় ধান ঝড়ে পড়ায় ফসল সংগ্রহের সময় ক্ষতি হয়। মাঠ থেকে মাড়াই করার স্থানে ধান গাছ নেয়ার সময় প্রায় ৭% ধান ঝরে পড়ে যায়। তাই এসময় বিশেষ সচেতনতা অবলম্বন করা উচিত। বর্তমানে খামার যান্ত্রিকীকরণের প্রসার বৃদ্ধি হচ্ছে। তাই রিপার মেশিন বা কম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে ধান কর্তন করলে সময়, শ্রম ও খরচ সবই কম লাগে।
ধান মাড়াই
ধান মাড়াইয়ের স্থানটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হওয়া উচিত। আমাদের ধান মাড়াইয়ের স্থানকে স্থানীয় ভাষায় খলা বলা হয়ে থাকে। প্রচলিত পদ্ধতিতে বাড়ীর উঠোনে গোবর দিয়ে লেপে শুকানোর পর সেখানে মাড়াই করা হয়। একটা সময় ছিল যখন গরু দিয়ে ধান মাড়াই করা হতো। বর্তমানে কৃষকেরা বিভিন্ন মাড়াই যন্ত্র ও অন্যান্য পদ্ধতির ব্যবহার করে থাকে। মাড়াই যন্ত্রে ধান মাড়াই সবচেয়ে সহজ। দুই ধরনের মাড়াই যন্ত্র যেমন পাওয়ার চালিত এবং পা চালিত মাড়াই যন্ত্র ব্যবহার হয়ে থাকে। মাটি বা উঠোনে সরাসরি ধান মাড়াই না করে চাটাই বা পাটি বা পলিথিন বা ত্রিপল এসব বিছিয়ে তার উপর মাড়াই যন্ত্র বসিয়ে মাড়াই করা ভাল। পা দিয়ে ধীরে ধীরে ধান মাড়াই করলে ধানে ক্ষতি কম হয় ও ধান পরিস্কার থাকে। গরু বা মাড়াই যন্ত্রে বীজ ধান মাড়াই করলে ধানের ক্ষতি হতে পারে। তাই বীজ ধান মাড়াইয়ের জন্য প্রচলিত আড়াই বাড়ি পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত। আড়াই বাড়ি পদ্ধতিটি হলো ধান কাটার পর তৈরিকৃত আটি একদিক থেকে একবার ও অন্যদিক থেকে আর একবার চাটাইয়ের উপর পিটিয়ে অত:পর হালকা ঝাড়ি দিয়ে ধান মাড়াই করা। এতে শুধু ভাল ও পুষ্ট ধানগুলো পাওয়া যায় যা বীজের গুনগত মানকে বাড়িয়ে দেয়। এভাবে মাড়াইয়ের পর আটির অবশিষ্ট ধানগুলো মাড়াই যন্ত্রের সাহায্যে মাড়াই করে নিতে হবে। উল্লেখ্য যে, কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহার করলে ধান কাটা, মাড়াই ও ঝাড়াই সবই একসাথে হয়ে যায়।
ধান শুকানো
মাড়াইকৃত ধান দ্রুত রোদে শুকানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ধান কমপক্ষে টানা ৪-৫ দিন রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। বর্ষায় ধান শুকানো কঠিন ও কষ্টকর। সেক্ষেত্রে ধান বৃষ্টির পানিতে যাতে না ভিজে তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। কড়া রোদ বা দুপুরে ধান শুকানো ঠিক নয়। এতে চাল ভেঙ্গে যেতে পারে। তবে দুপুরের রোদে ধানের উপর খড় বিছিয়ে ঢেকে শুকানো যেতে পারে। ধান দাত দিয়ে কামড় দিলে কট করে শব্দ হলে বুঝতে হবে ধান শুকিয়ে গেছে। বীজ ধানের ক্ষেত্রে আরোও অধিকতর সর্তক হয়ে ধান শুকাতে হবে। এক্ষেত্রে রোদ ও ছায়ায় পর্যায়ক্রমে শুকিয়ে নিতে হবে। বীজ ধান সংরক্ষণের জন্য ধানের আর্দ্রতা হবে শতকরা ১২ ভাগ। বর্তমানে ধান শুকানোর জন্য ড্রায়ার মেশিন ব্যবহার করা হয়।
ধান সংরক্ষণ
ধান সংরক্ষণের জন্য সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। ধান সংরক্ষণকালীন সময়ে বড় সমস্যা হলো আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা। আর্দ্রতা ও তাপমাত্রার প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য পলিথিনসহ বড় বড় বস্তা, ডোল বা ডুলি বা বাঁশের তৈরি বেড় ব্যবহার করা যেতে পারে। তাছাড়া সম্ভব হলে ধাতবপাত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। ধান সংরক্ষণের সময় নিমপাতা বা তামাক পাতা বা বিষকাটালীর পাতা শুকিয়ে গুড়া করে ডুলির চারপাশ ও উপরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিলে পোকামাকড়ের আক্রমন কম হয়। বীজ ধানের ক্ষেত্রে অধিকতর বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, ডুলির নিচের অংশ যেন কোন অবস্থাতেই মাটির সংস্পর্শে না থাকে। সর্বোপরি ধান অতিদ্রুত বাজারজাত করা উচিত।
গবেষণায় দেখা যায়, আমাদের দেশে ফলনোত্তর পর্যায়ে গড়ে শতকরা ১২-১৩ ভাগ ফসলহানি ঘটে । অর্থ্যাৎ প্রায় ৪১ লাখ মে.টন ধান ফসলহানি ঘটে। মাঠে উৎপাদিত ধান একটু সচেনতার সাথে পরিকল্পনামাফিক কাজ করলে ও সচেতন হলে কোটি কোটি টাকার ধান রক্ষা করা যায়।
- Advertisement -
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.