- Advertisement -
প্রতিটা ছুটিই হউক গ্রীষ্মময়…
কৃষিবিদ মোহাইমিনুর রশিদ
ছুটি শব্দটি শুনা মাত্রই শিহরিত, পুলকিত ও আনন্দিত হয় মন। অবকাশের নিমিত্তেই ছুটির ব্যবহার। অনাদিকাল থেকেই আমাদের স্কুল কলেজের সংস্কৃতির সাথে গ্রীষ্মকালীন ছুটি ঔতোপ্রোতভাবে জড়িত। আঞ্চলিকতাভেদে অনেকে গ্রীষ্মকালীন ছুটিকে আম কাঠালের ছুটিও বলে থাকেন। কেননা এসময় মধুর মাস। আম, কাঁঠাল, লিচু, জামসহ বাংলাদেশের প্রায় অধিকাংশ ফল পাকার মৌ মৌ গন্ধ ভেসে বেড়ায়। বাহারি মৌসুমি ফলের সুবাসিত ঘ্রানে পুলকিত হয় শরীর মন। প্রকৃতি এক ভিন্ন আমেজের মাতোয়ারা হয়। স্কুল কলেজ ছুটি হলে এসময়টায় মজা করে এসব ফল ফলাদি পেট ভরে খাওয়া যায়। তাছাড়া এ সময় কালবৈশাখি ঝড় বাদলের। কবি জসীম উদ্দিন তাইতো বলেছেন “ঝড়ের দিনে মামার দেশে, আম কুড়াতে সুখ; পাকা জামের মধুর রসে, রঙিন করি মুখ”।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে বাংলাদেশের মোট ফল উৎপাদনের শতকরা ৬০ ভাগ ফল বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় এবং শ্রাবণ (মে-আগস্ট) মাসে উৎপাদিত হয়। অবশিষ্ট আটমাসে শতকরা ৪০ ভাগ ফল বিচ্ছিন্ন ও বিভিন্ন মাত্রায় পাওয়া যায়। আরোও বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত উৎপাদিত হয় মোট ফলের ১৯% যার মধ্যে কুল, বেল, কলা, সফেদা অন্যতম। তাছাড়া সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে উৎপাদিত হয় শতকরা ২১ ভাগ ফল যেমন আমড়া, কামরাঙা, কদবেল, চালতা অন্যতম। অন্যদিকে কিছু কিছু ফল ফলাদি আছে যেগুলো সারাবছরই ধরে যেমন কলা, পেঁপে, আনারস, নারিকেল এসব ফল। বিজ্ঞানীদের মতে একজন সুস্থ প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের গড়ে দৈনিক ১১৫ থেকে ১২৫ গ্রাম ফল খাওয়া দরকার। খাদ্যশস্যে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ তবে পুষ্টিমানে অনেক ঘাটতি রয়েছে। এক গবেষণায় জানা যায়, গর্ভাবস্থায় শিশুর বুদ্ধির বিকাশ হয় শতকরা ৬০ ভাগ এবং জন্মের পর ৫ বছর পর্যন্ত বাকি ৪০ ভাগ বুদ্ধির বিকাশ হয়ে থাকে। এসময়ে তাই একটু বেশিই পুষ্টিমান খাবার খাওয়া উচিত। পুষ্টি বিবেচনায় ফলের গুরুত্ব সবার আগে, তাছাড়া দেশি ফলে পুষ্টিগুণ অনেক বেশি।
তাসিন ও সুরভি দুই ভাইবোন। দুজনের মাঝে বয়সের ফারাক খুবই কম। সুরভি বয়সে বড়, মাধ্যমিক স্কুলে ১০ম শ্রেণিতে পড়ে। আর তাসিন ৭ম শ্রেণিতে। সিলেট সদরের হাটখোলা ইউনিয়নের রাজারগাও উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ে। চটপটে দুরন্তপনায় কেটে যাচ্ছে তাদের কৈশোর। দুজনই জ্ঞান চর্চায় খুবই পন্ডিত। বিজ্ঞানের এ যুগে কৃষি বিজ্ঞানের প্রতি হঠাৎ তাদের খুব আগ্রহ বেড়ে গেল। কারণটা মূলত বেশ কিছুদিন পূর্বে কৃষি তথ্য সার্ভিসের সহযোগিতায় তাদের স্কুলে কৃষিভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়েছিল। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে অন্যান্য সকল ছাত্রছাত্রীদের মতো তারাও উপভোগ করেছিল। অনেকগুলো প্রামাণ্যচিত্রের মধ্যে তাদের কিশোর মনে দাগ কেটেছিল খাদ্যে বিষ ও ফলে কার্বাইড ব্যবহার এই প্রামাণ্যচিত্রগুলো। তাই ফরমালিন ও কার্বাইড সর্ম্পকে বিশদভাবে জানার তাগিদ উকিঝুকি করছিল তাদের কিশোর মননে। পড়ার টেবিল বসে বসে তাসিন ফরমালিন কথা চিন্তা করে। আর সুরভির চিন্তা কার্বাইড নিয়ে। এলোমেলো চিন্তায় মাঝে মাঝে ভাবনায় পড়ে তারা। তাই একদিন রাতের খাবারের সময় তারা তাদের বাবার কাছে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। বিস্তারিত জানতে চায় বাবার কাছে। কয়েকদিন পর হঠাৎ বাবাকে স্কুলে দেখে তারা চকিত হয়। স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সাথে বাবা এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। প্রধান শিক্ষক আশ্বস্থ করেন তিনি কৃষি তথ্য সার্ভিসের আঞ্চলিক বেতার কৃষি অফিসার মহোদয়কে স্কুলে দাওয়াত দিয়ে আনবেন। এ বিষয়ে সচেতনামুলক একটি সেমিনারের আয়োজন করবেন। সময় সুযোগে যথারীতি একদিন সেমিনারের আয়োজন করা হলো।
সেমিনারে আঞ্চলিক বেতার কৃষি অফিসার মহোদয় ফরমালিন ও কার্বাইডের ব্যাপারে বিস্তারিত আলাপ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ফল আমাদের খাদ্য ও পুষ্টির একটি অন্যতম উৎস। সাম্প্রতিক সময়ে কতিপয় অস্বাদু ব্যবসায়ী ও ফল চাষি কৃত্রিমভাবে ফল পাকানোর জন্য বিষাক্ত কার্বাইড ব্যবহার করে থাকে। ফলে মিশানো রাসায়নিকের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর হলো ক্যালসিয়াম কার্বাইড। ক্যালসিয়াম কার্বাইড এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ। এটি এক ধরনের যৌগ, যা বাতাসে বা জলীয় সংস্পর্শে এলেই উৎপন্ন করে এসিটিলিন গ্যাস। যা ফলে প্রয়োগ করলে এসিটিলিন ইথানল নামক বিষাক্ত পদার্থে রুপান্তরিত হয়। কার্বাইডের ব্যবহারে অপরিপক্ক, কাঁচা, আধা কাঁচা ফলগুলোকে পাকিয়ে সুন্দর বর্ণিল রঙের করে দেয়। চকচকে, দৃষ্টিনন্দন টকটকে লাল, হলুদ, গোলাপিসহ বাহারি বর্ণে রুপান্তরিত করে। যা সহজেই ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে। কার্বাইড ব্যবহারে ফলের সৌন্দর্য হয় ঠিকই কিন্তু ফলের পুষ্টি গুণাগুণ নষ্ট হয় তাছাড়া ফল খেতে বিস্বাদ, পানসা, শক্ত ও তেতো স্বাদযুক্ত মনে হয়। মজার ব্যাপার হলো রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে বা কৃত্রিমভাবে পাকানো ফলের ত্বক সুষম রঙ ধারণ করে, যা অনেকটা বেশিই সুন্দর দেখায়। অন্যদিকে ফরমালিন ব্যবহারে ফল ও সবজি বেশিদিন তাজা রাখে। এসব রাসায়নিক পদার্থ মানুষের শরীরে বিভিন্ন জটিল রোগ সৃষ্টি করতে পারে যেমন বদহজম, পেটের পীড়া, পাতলা পায়খানা, গ্যাস্ট্রিক, শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, লিভার ও কিডনি নষ্ট হওয়াসহ ক্যান্সারের মতো মারাত্নক জীবন নাশক রোগ হতে পারে। তাছাড়া এর প্রভাবে বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম নিতে পারে। তবে ভয়ংকর বিষয় হলো, এসব রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহারের জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় কোমলমতি শিশুরা।
তাসিন, সুরভিসহ উপস্থিত সকলেই কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। হঠাৎ সুরভি দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে বসল, স্যার এসব থেকে রক্ষা পাবার উপায় নাই। মহোদয় খুবই সাবলীলভাবে বললেন, হ্যাঁ অবশ্যই আছে। সহজ ভাষায় বললে, ফল খাবে তো গাছ লাগিয়ে খাও। তাসিন বলে উঠল স্যার আমাদের দেশের ফলতো গ্রীষ্মকালীন ছুটি সময়ইতো বেশি পাই, বছরের বাকিটা সময় আমরা কিভাবে ফল খাব? তখনতো খুব বেশি ফল পাওয়া যায় না। উপস্থিত সকলেই হইহই করে তাসিনের সাথে বলতে লাগল স্যার আমরা সারা বছরই ফল খেতে চাই। তখন অফিসার মহোদয় সুন্দরভাবে বললেন, তোমরা নিরব হয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনো, আমি কি বলি। কৃষি গবেষণা করে সারাবছর ফল খাওয়ার কৌশল আবিষ্কার করেছেন। তা আমি তোমাদের শুনাচ্ছি। প্রথমেই তোমাদের বাড়ির আঙ্গিনার খালি জায়গাগুলোকে ভালোভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে নিয়ে একটা ফলবাগান তৈরির নকশা করে নিতে হবে। জানুয়ারি মাসে খাওয়ার জন্য বাড়ির একপাশে কয়েকটি মাল্টা, আমলকি গাছ লাগিয়ে দিতে হবে। ফেব্রুয়ারি মাসের জন্য কুল, কদবেল, গোলাপজামের গাছ লাগানো যায়। মার্চ মাসে প্রচুর গরমে বেলের শরবত খুবই উপকারি, তাই বেল গাছ লাগাতে হবে। তরমুজ, কাজুবাদামের স্বাদ এপ্রিলে পাওয়া যায়। রক্ত পরিষ্কার করতে কালো জামের বিকল্প নেই, তাই মে মাসে ফল খাওয়ার জন্য কালো জাম গাছ রোপন করতে হবে। জুন মাস চুড়ান্ত মধুর মাস এমাসে আম, লিচু অনায়সের পাওয়া যায়। জুলাই মাসে খাওয়ার জন্য জাতীয় ফল কাঁঠাল ও লটকন রোপণ করতে পার। পেয়ারা সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় আগস্ট মাসে। সেপ্টেম্বর পুরোটাতে আমড়া খেতে পারবে, তাই আমড়া গাছ লাগাবে। অক্টোবর মাসে জলপাই এবং নভেম্বর মাসের জন্য ডালিম এবং সবশেষে ডিসেম্বর মাসের জন্য কমলাকে বেছে নিতে পার। কি মনে থাকবে তোমাদের। সবাই হু হু করে বলে উঠল অবশ্যই থাকবে স্যার। এখন বর্ষাকাল চলছে তাই এখনই বিশ্বস্থ নার্সারি থেকে ফলগাছের চারা সংগ্রহ করে হবে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ফলগাছের চারা রোপণ করতে হবে। কলমের চারায় দ্রুত ফল আসে। ঠিক আছে, বুঝেছ তোমরা; সবাই আনন্দে বিহব্বল হয়ে বলল জি স্যার। আজই বাড়িতে গিয়ে আব্বাকে বলব ফলগাছের চারা কিনে দিতে।
এখন ২০২১ সালের একেবারে শেষের দিকে, সরকারের ভিশন ২০২১ সফলতার সাথে অর্জিত হয়েছে। পুষ্টিমানেও বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ঈষর্ণীয়। সিলেট সদরের হাটখোলা ইউনিয়নের রাজারগাও উচ্চ বিদ্যালয়ের তৎকালীন নবম দশন শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা এখন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। সুরভি এখন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের ছাত্রী। তাসিন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিবে। স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়ে যথারীতি গ্রীষ্মের ছুটি হয় তারা বাড়িতে যেয়ে ফল খায়। তবে ব্যতিক্রম শুধু একটাই, সেদিনে স্যারের কথামতো বছরব্যাপী ফল খাওয়ার কলাকৌশলে যে ফলগাছগুলো লাগিয়েছিল, তার প্রত্যেকটি গাছেই ফল ধরে। সারাবছরই ফলের সমারোহে মাতোয়ারা হয়ে থাকে বাড়ির আঙিনা। এখন তাদের কাছে প্রতিটা ছুটিই যেন গ্রীষ্মের ছুটির মতো মনে হচ্ছে।
- Advertisement -
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.