- Advertisement -

পেঁয়ারা গাছে অসময়ে ফলধারণ এবং বিশেষ ব্যবস্থাপনা

পেঁয়ারা গাছে অসময়ে ফলধারণ এবং বিশেষ ব্যবস্থাপনা

687

- Advertisement -

 

পেঁয়ারা গাছে অসময়ে ফলধারণ এবং বিশেষ ব্যবস্থাপনা

কৃষিবিদ মোহাইমিনুর রশিদ

অত্যন্ত জনপ্রিয় ও ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ ফল পেঁয়ারা। বাংলাদেশের সর্বত্রই কম বেশি এ ফল জন্মে থাকে। প্রাথমিকভাবে পেঁয়ারার বাণিজ্যিক চাষাবাদ পিরোজপুর, চট্রগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসব জেলায় কিছু কিছু এলাকায় চাষ হয়। বর্তমানে পেঁয়ারার কতগুলো উন্নতজাত ও নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে পেঁয়ারা চাষে কৃষক উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। এখন সারাদেশেই এ ফলের বাণিজ্যিক চাষাবাদ হচ্ছে। বহুবিধ গুণাগুণের সমন্বয়ের জন্য পেঁয়ারাকে নিরক্ষীয় এলাকার আপেল বলা হয়। মুচমচ করে টাটকা পেঁয়ারা খাওয়ার মজাই অন্যরকম। তাছাড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে জ্যাম, জেলী, জুস এসব তৈরি করেও পেঁয়ারা খাওয়া যায়। আমাদের দেশে বেশ কয়েকটি উন্নত জাতের পেঁয়ারা যেমন কাজী পেঁয়ারা, বারি পেঁয়ারা-২, বারি পেঁয়ারা-৩ (লাল শাঁস বিশিষ্ট), বাউপেঁয়ারা-১ থেকে বাউপেঁয়ারা-৯ পর্যন্ত, ইপসাপেঁয়ারা পাওয়া যায়। স্থানীয় জাতের মধ্যে স্বরুপকাঠি, কাঞ্চননগর ও মুকুন্দপুরী অতি জনপ্রিয় জাত। সাম্প্রতিক সময়ে থাই পেঁয়ারা চাষে কৃষকদের ব্যাপক আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।

পেঁয়ারা গাছের বৈশিষ্ট্য 

পেঁয়ারা খেতে খুবই সুস্বাদু, মুচমুচে ও সুমিষ্ট। পেঁয়ারাকে ভিটামিন সি এর ব্যাংক বলা যায়। পেঁয়ারা গাছ মাঝারি আকারের শাখা প্রশাখা বিশিষ্ট আকৃতির হয়ে থাকে। শীতের সময় পাতা ঝরে পড়ে। বসন্তের শেষের দিকে পেঁয়ারা গাছে নতুন পাতা ও ডগা আসে। সাধারণত বর্ষা ও শীত ঋতুতে গাছে পেঁয়ারা হয়। তবে শীত অপেক্ষা বর্ষাকালে ফলন একটু বেশি হয়। বর্ষাকালে জলীয় ভাব বেশি থাকায় ফলের মিষ্টতা ও অন্যান্য গুণাগুণ শীতকালের ফলের থেকে অনেকাংশেই কম থাকে। তাছাড়া জলীয়ভাব বেশি থাকায় পাকা ফল তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়, যার ফলে দাম থাকে কম। পরীক্ষা করে দেখা গেছে সকল জাতের পেঁয়ারার গুণাগুণ শীতকালে বেড়ে যায়, রোগ ও পোকার আক্রমণও কম থাকে। ফলের আকৃতি এবং রঙ সবদিক থেকেই সুন্দর হওয়ায় এই সময়ে পেঁয়ারার দামও থাকে বেশি। এসব দিক বিবেচনায় রেখেই বর্ষাকাল বাদে কীভাবে অন্যান্য ঋতুতে অত্যাধিক হারে উৎপাদন বাড়ানো যায় সে ব্যাপারে গবেষণা শুরু হয়। অত্যন্ত আশার কথা যে, গবেষকরা আজ এ ব্যাপারে সার্থক হয়েছেন। পেঁয়ারা গাছে অসময়ে ফলধারণ এখন খুব সহজেই সম্ভব হয়।

পেয়ারা গাছে অসময়ে ফলধারণের পদ্ধতিসমূহ
বর্তমানে পেঁয়ারা গাছে বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের জন্য কৃষি বিজ্ঞানীগণ বেশ কয়েকটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। সেগুলো হলো শিকড় উন্মুক্তকরণ পদ্ধতি, হরমোন জাতীয় পদার্থ প্রয়োগ পদ্ধতি ও শাখা-প্রশাখা বাঁকানো পদ্ধতি।

ক) শিকড় উন্মুক্তকরণ পদ্ধতি
পেঁয়ারা গাছের গোড়ার মাটি তুলে বা আলগা করে দিতে হবে। মাটি তুলে দিয়ে গাছের শিকড়গুলো বের করে নাড়া চাড়া দিয়ে দিতে হবে। গাছের গোড়া থেকে ০১ থেকে ১.৫ মিটার (পেঁয়ারা গাছের ক্যানপি) পর্যন্ত মাটি কোদাল, শাবল বা নিড়ানি দ্বারা খুব ভালোভাবে সাবধানতার সাথে মাটি উন্মুক্ত করে দিতে হবে। মাটি তুলে দেওয়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে, গাছের শিকড়গুলো কেটে না যায়। বিশেষ করে গাছের আসল মূল (টেপ রুট) কাটা ও উৎপাটন করা যাবে না। গাছ নাড়ানো যাবে না। সাধারণত যে কোন বয়সের পেঁয়ারা গাছে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায়। গোড়ার মাটি উন্মুক্ত করার কমপক্ষে ১০-১৫ দিন পর পরিচর্যা করতে হবে। পরিচর্যাকালে পরিমাণমত সার ও সেচ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এ পদ্ধতিতে গাছের পাতা লাল হয়ে ঝড়ে যেতে পারে। আমাদের দেশে এপ্রিল-মে মাসে পেঁয়ারা গাছে শিকড় উন্মুক্ত করতে হয়। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করলে পেঁয়ারা গাছে ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে ফলধারণ করে।

খ) হরমোন জাতীয় পদার্থ প্রয়োগ পদ্ধতি
সাধারণত ২-৫ বছর বিশিষ্ট পেঁয়ারা গাছে হরমোন প্রয়োগ করতে হয়। এপ্রিল-মে মাসে হরমোন প্রয়োগ করার উৎকৃষ্ট সময়। এই সময়ে হরমোন জাতীয় পদার্থ হিসেবে ২,৪-ডি; ন্যাপথালিন এসিটিক এসিড (এনএএ), ১০% ইউরিয়ার দ্রবণ এসব রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়। স্প্রে মেশিন বা ফুট পাম্প দিয়ে খুব ভালো করে পেঁয়ারা গাছের পাতা ভিজিয়ে দিতে হবে। কয়েক দিনের মধ্যেই গাছের পাতা লালচে হয়ে ঝড়ে যেতে পারে। পরবর্তীতে গাছে সঠিক পরিচর্যা নিলে নতুন পাতা জন্মাবে এবং অসময়ে ফলধারণ হবে।

গ) শাখা-প্রশাখা বাঁকানো পদ্ধতি
শাখা-প্রশাখা বাঁকানো পদ্ধতি সম্পূর্ণ নতুন প্রযুক্তি। পেঁয়ারার ডাল বাঁকালেই প্রায় দশগুণ বেশি ফলন হয়। তাছাড়া একই প্রযুক্তিতে বছরের বার মাসই ফল ধরানো সম্ভব হয়। ফলের মৌসুমে গাছের ফুল ছিড়ে দিয়ে এ প্রক্রিয়াকে আরো প্রভাবিত করা যায়, যার ফলে সারা বছরই ফলের মৌসুমের তুলনায় কমপক্ষে আট থেকে দশগুণ ফল ধরবে গাছে। এ লক্ষ্যে ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে গবেষণার মাধ্যমে ‘গাছের ডাল বাঁকানো’ পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। বছরে দু’বার অর্থাৎ গ্রীষ্মকালে এবং হেমন্তকালে শাখা- প্রশাখার নিয়ন্ত্রিত বিন্যাসের মাধ্যমে সারা বছর পেঁয়ারার ফুল ও ফলধারণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। গাছের বয়স দেড় থেকে দু’বছর হলেই এই পদ্ধতি শুরু করা যাবে এবং পাঁচ থেকে ছয় বছর পর্যন্ত এই পদ্ধতিতে ফলন বাড়ানো সম্ভব। ডাল বাঁকানোর ১০ থেকে ১৫ দিন আগে গাছের গোড়ায় সার ও পানি দিতে হয়। ডাল বাঁকানোর সময় প্রতিটি শাখার অগ্রভাগের প্রায় এক থেকে দেড়ফুট অঞ্চলের পাতা ও ফুল-ফল রেখে বাকি অংশ ছেটে দিতে হয়। এরপর ডালগুলোকে সুতা দিয়ে বেঁধে তা বাঁকিয়ে মাটির কাছাকাছি করে সাথে অথবা খুঁটির মাধ্যমে মাটিতে বেঁধে দিতে হয় । গ্রীষ্মকালে মাত্র দশ থেকে বার দিন পরেই নতুন ডাল গজানো শুরু হয়। নতুন ডাল ১ সে.মি. লম্বা হলে বাঁধন খুলে দেওয়া হয়। আর হেমন্তকালে নতুন ডাল গজাতে বিশ থেকে পঁচিশ দিন সময় লাগে। ডাল বাঁকানোর ৪৫ থেকে ৬০ দিন পরে ফুল ধরা শুরু হয়। এভাবে গজানো প্রায় প্রতি পাতার কোলেই ফুল আসে। এ পদ্ধতিতে সারা বছরই ফলন পাওয়া যায়।

বিশেষ ব্যবস্থাপনাসমূহ
পেঁয়ারা গাছের আকার আকৃতি, কাঠামো ও গুণগত মানের ফলধারণের জন্য গাছে বিশেষ কতগুলো ব্যবস্থাপনা করা যায়। এ ব্যবস্থাপনাগুলোর মধ্যে অঙ্গ ছাঁটাই, ডাল নুয়ে দেয়া, ফুল ছিড়ে দেয়া, ফল পাতলাকরণ, ফল ঢেকে দেয়া এসব পদ্ধতি।

অঙ্গ ছাঁটাই: গাছের মরা, শুকনা, চিকন, লিকলিকে, রোগাক্রান্ত ও প্রয়োজনহীন ডালপালা ছাঁটাই করাকে অঙ্গ ছাঁটাই বলা হয়। রোপণকৃত চারা বা কলমের আকার, আকৃতি ও কাঠামো সুন্দর করার উদ্দেশ্যে মাটি থেকে ১.০ থেকে ১.৫ মিটার উপরে বিভিন্ন দিকে ছড়ানো ৪-৫ টি ডাল রেখে গোড়ার দিকের সমস্ত ডাল ছাঁটাই করে দিতে হবে। বয়স্ক গাছের ফল সংগ্রহের পর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে অঙ্গ ছাঁটাই করা হয়। এতে গাছে নতুর ডালপালা গজায়, প্রচুর ফুল হয় এবং গুণমানের উৎকৃষ্ট ফলধারণ করে।

ডাল নুয়ে দেয়া: পেঁয়ারা গাছের খাড়া ডালে সাধারণত ফুল ও ফল খুবই কম ধরে। তাই খাড়া ডালগুলোকে যদি ওজন বা টানার সাহায্যে নুয়ে দিলে প্রচুর পরিমাণ নতুন শাখা গজায় । নতুন ডালপালায় গুণগতমানের ফলধারণ ও ফলন বৃদ্ধি পায়।

ফুল ও ফল পাতলাকরণ: কাজী পেঁয়ারা ও বারি পেঁয়ারা-২ এর গাছে প্রতি বছর প্রচুর সংখ্যক ফুল ও ফল আসে। ফল আকারে বড় হওয়ার গাছের পক্ষে সব ফল ধারণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। ফলের ভারে ডালপালা ভেঙ্গে যায় এবং ফল আকারে ছোট ও নিম্নমানের হয়। এমতাবস্থায়, গাছকে দীর্ঘদিন ফলবান রাখতে ও মানসম্পন্ন ফল পেতে হলে প্রথমেই কিছু ফুল এবং পরে ফল ছোট থাকা অবস্থায় (মার্বেল অবস্থা) ৫০-৬০% ফল পাতলা করে দেয়া দরকার। কলমের গাছের ক্ষেত্রে কোন অবস্থাতেই প্রথম বছর ফল নেয়া উচিত হবে না। তাই ফুল আসার সাথে সাথে ছিড়ে ফেলে দেয়া প্রয়োজন। দ্বিতীয় বছর অল্প পরিমাণ ফল নেওয়া ভালো। এভাবে গাছের বয়স ও অবস্থা বুঝে ফল রাখতে হবে। পরিকল্পিত উপায়ে ফুল বা ফল পাতলা করে প্রায় সারাবছর কাজী পেঁয়ারা ও বারি পেঁয়ারা-২ জাতের গাছে ফল পাওয়া যাবে।

ফলের ব্যাগিং বা ফল ঢেকে দেয়া: পেঁয়ারা ছোট অবস্থাতেই ব্যাগিং করলে রোগ, পোকামাকড়, পাখি, বাদুর, কাঠবিড়ালি এসব থেকে সহজেই রক্ষা করা যায়। ব্যাগিং করা ফর অপেক্ষাকৃত বড় আকারের এবং আর্কষণীয় রঙের হয়। ব্যাগিং বাদামী কাগজ বা ছোট ছিদ্রযুক্ত পলিথিন দিয়ে করা যেতে পারে। ব্যাগিং করলে সূর্যেও আলট্রাভায়োলেট রশ্মি থেকে প্রতিহত হয় বিধায় কোষ বিভাজন বেশি হয় এবং ফল আকারে বড় হয়। ব্যাগিং করার পূর্বে অবশ্যই প্রতি লিটার পানির সাথে ০.৫ মিলি হারে টিল্ট ২৫০ ইসি মিশিয়ে সমস্ত ফল ভালভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।

বর্তমানে বাংলাদেশে পেঁয়ারার উৎপাদন মাত্র ১ লাখ ৬১ হাজার মে. টন। বাংলাদেশের আবহাওয়া, জলবায়ু, মাটি এসব পেঁয়ারা চাষের জন্য খুবই উপযোগী। তাছাড়া অসময়ে ফলধারণের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগুলো গবেষকগণ উদ্ভাবন করেছেন। বিশেষ ব্যবস্থাপনাসমূহের মাধ্যমেও সহজেই পেঁয়ারা চাষে আর্থিক লাভবান করা সম্ভব। তাই পরিকল্পিত উপায়ে প্রযু্িক্তভিত্তিক পেঁয়ারা চাষের প্রতি কৃষক ভাইদের উদ্বুদ্ধ ও বাস্তবায়ন করার জন্য গবেষক, বিজ্ঞানী, সম্প্রসারণবিদ, কৃষি কর্মী সর্বোপরি সরকারের বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার।

 

- Advertisement -

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.