- Advertisement -
নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও করণীয়
কৃষিবিদ মোহাইমিনুর রশিদ
ক্রমবর্ধমান জনমানুষের মুখে দুবেলা খাবার তুলে দেয়ার চ্যালেঞ্জ নিতে গিয়ে কৃষিজ পণ্য উৎপাদনের গুণগত মান যাচাই বাছাই করার ফুসরৎটুকু আমাদের নেই। ফসলের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য রাসায়নিক সার, রাসায়নিক বালাইনাশক, গ্রোথ হরমোন, এন্টিবায়োটিক এসব রাসায়নিকের উপর নির্ভর হয়ে যাচ্ছে কৃষিজ ব্যবস্থাপনা। তাইতো দেখা যায়, কৃত্রিম সার, কীটনাশক, ছত্রাকনাশক, ফসল উজ্জীবকসমূহ শুধুমাত্র মাটি, পানি ও বায়ুকেই দূষিত করছে না বরং মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বাঁধা হয়ে পিরামিডের পিলারের মতো সামনে দাড়াচ্ছে। কৃষিজ পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে ঝুকিপূর্ণ সেক্টর হলো শাকসবজি ও ফলমূল। তাই স্বাস্থ্য সচেতন আপামর মানুষরাই এই বিষ থেকে মুক্তির সোচ্চার দাবি তুলছে। মানুষের মুখে নিরাপদ খাদ্য তুলে দেওয়াটাই আজ কৃষি বিভাগের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
নিরাপদ খাদ্য: সহজ করে বলতে গেলে, যে সব খাদ্য মানুষের স্বাস্থের কোন ঝুকি সৃষ্টি করে না তাই নিরাপদ খাদ্য।
নিরাপদ ফসল উৎপাদনের অন্তরায়সমূহ
১. রাসায়নিক সার
রাসায়নিক সার যেমন ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি, এমওপি, সলুবোরণ, জিপসাম ইত্যাদি। ফসল বৃদ্ধিতে রাসায়নিক সার খুবই উপকারী তবে বেশি সারে বেশি ফসল এ কথাটি মোটেও সত্য নয়। জমিতে পরিমিত মাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহার করা উচিত। অপরিকল্পিতভাবে রাসায়নিক সার ব্যবহার করলে জমির উর্বরতা শক্তি নষ্ট হয়ে যায়। মাটির উৎপাদনশীলতা কমে যায়। সার মিশ্রিত ফসলগুলোর গুণগত মান কমে যায়। অনেক সময় স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ভারী ধাতু যেমন ক্যাডমিয়ামের মতো ধাতুর অস্তিৃত্ব চালে পাওয়া যায়। ফলে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়। তাছাড়া পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হয়।
২. রাসায়নিক বালাইনাশক
বীজ শোধন থেকে শুরু করে শস্য গুদামজাত পর্যন্ত ফসলের নিরাপত্তার জন্য কৃষকরা নিরবিচ্ছিন্নভাবে রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহার করে থাকে। এই রাসায়নিক বালাইনাশকগুলোই আমাদের পরিবেশকে নিদারুণভাবে বিনষ্ট করে জীব বৈচিত্র্যকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। পাশাপাশি আমরাও বিষযুক্ত শাকসবজি ও ফলমূল খাচ্ছি।
৩. ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার
নিয়মিত বিরামহীনভাবে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার নির্মল পরিবেশের জন্য বিপদজনক। আমরা প্রতিনিয়ত ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে কৃষি কাজ পরিচালনা করছি। ফলে একদিকে ভূগর্ভস্থ পানি কমে গিয়ে মারাত্বক ভূমিকম্প হতে পারে পাশাপাশি বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত পানি দ্বারা চাষকৃত জমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে। মানুষ বিভিন্ন রকম রোগ মহামারীর আক্রান্ত হচ্ছে।
৪. ফল পাকাতে রাসায়নিক পদার্থ
ক্যালসিয়াম কার্বাইড এক ধরণের রাসায়নিক পদার্থ। এটি এক ধরণের যৌগ যা বাতাসে বা জলীয় সংস্পর্শে এলেই উৎপন্ন হয় এসিটিলিন গ্যাস। যা ফলমুলে প্রয়োগ করলে এসিটিলিন ইথানল নামক বিষাক্ত পদার্থে রূপান্তরিত হয়। পরবর্তীতে আর্সেনিক ও ফসফরাস গ্যাস উৎপন্ন হয়। যা মানব শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর। তাছাড়া আরোও একটি মারাতœক রাসায়নিক হলো ইথেফোন । ইহা একটি ইথিলিন শ্রেণীর রাসায়নিক দ্রব্য। এটিও ফল পাকায়। সাধারণত এটি প্রয়োগের ফলে ইথিলিন গ্যাস নিঃসরণ হওয়ার কারণে ফলের রঙ বদলায় ও ফল দ্রুত পেকে যায়। অপরিপক্ক ফলে অনির্ধারিত বা অসমমাত্রায় এ রাসায়নিক টি ব্যবহারের কারণে ফলের পুষ্টিমান কমে যায়, স্বাদ খারাপ হয় এবং বিভিন্ন অসুখ বিসুখসহ জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়।
৫. শাকসবজি তাজা রাখতে রাসায়নিক পদার্থ
ফরমালিন একটি রাসায়নিক যা ৩৭% থেকে ৪১% ফরমালডিহাইডের জলীয় দ্রবণ। এটি বর্ণহীন, ঝাঁঝালো বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। ফরমালিন একটি বিষাক্ত পদার্থ। এটি খাদ্য দ্রব্য ও কৃষিপণ্য সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণে ব্যবহারের জন্য অনুমোদিত নয়। এটি সাধারণ মৃত নমুনা সংরক্ষণে হাসপাতাল মর্গ, গবেষণাগার এবং বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান যেমন পেইন্ট, প্লাস্টিক শিল্প, টেক্সটাইল ও নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত হয়। এটি জীবানু প্রতিরোধী/জীবাণুনাশক বিধায় পচনশীল কৃষিপণ্য যেমন ফল, সবজি, দুধ মাছ এসব সংরক্ষণে প্রায়ই অসাধু ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করে থাকে। এটি জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ। এটি মানুষের কিডনি, লিভার ও ¯œায়ুতন্ত্রের ক্ষতি করে। শাকসবজি, আমসহ বিভিন্ন কৃষিজাতপণ্য ও খাদ্য দ্রব্যে ফরমালিনের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৫ এ ফরমালিন ব্যবহার রোধে জেল জরিমানাসহ কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে।
নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে করণীয়
জৈবসারের ব্যবহার-কম্পোস্ট সার, কেঁচো কম্পোস্ট, কুইক কম্পোস্ট-সার ব্যবহার বৃদ্ধি করা। মাটি পরীক্ষা করে জমিতে প্রয়োজনীয় রাসায়নিক সার নিয়ম মোতাবেক প্রয়োগ করা। ইউরিয়া সারের প্রয়োগ কমিয়ে ডিএপি সারের ব্যবহার বাড়ানো। ফসল উৎপাদনে আইপিএম কৌশল- জৈবিক বালাই ব্যবস্থাপনা-ভেষজ বালাইনাশক ব্যবহার, উপকারি পোকামাকড় সংরক্ষণ ও বৃদ্ধিকরণ, আইল ফসল চাষাবাদ; বালাইসহনশীল জাত ব্যবহার করা; আধুনিক কৃষি চাষাবাদ ব্যবস্থাপনা যেমন ভালো বীজ ব্যবহার, বীজ শোধন, আদর্শ বীজতলা তৈরি, মাটি শোধন করা, সেক্স ফেরোমন ট্রেপ ও বিষটোপ ব্যবহার, সার ব্যবস্থাপনা, আগাছা ব্যবস্থাপনা, পানি ব্যবস্থাপনা, সঠিক সময়ে ফসল মাড়াই করা এসব; যান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা যেমন হাত জাল, আলোক ফাদ এসব মেনে চলা, অবশেষে বালাইনাশকের যুক্তিসম্মত ব্যবহার অর্থ্যাৎ সঠিক বালাইনাশক নির্বাচন, সঠিক মাত্রায় সঠিক সময়ে ও সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করে বালাইনাশক স্প্রে করা উচিত। তাছাড়া ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারে যথেষ্ট শিথিলতা বজায় রাখা উচিত।
- Advertisement -
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.