- Advertisement -
প্রাচীন ফল তৈকর
কৃষিবিদ মোহাইমিনুর রশিদ
তৈকর পূর্ববঙ্গের আসাম তথা বাংলাদেশের একটি আদি ফল। বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে তৈকর চাষ হয়। সিলেট অঞ্চলে ফলটির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশের অন্যান্য জেলায়ও তৈকর চাষ করা সম্ভব। ভারতের আসাম প্রদেশের সাথে সংযুক্ত সিলেট অঞ্চলের সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলোতে তৈকর খুব ভালো জন্মায়। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশ মায়ানমার এবং ভারতের উত্তর পূর্ব এলাকা, আফ্রিকা ও পলিনেশিয়ায় তৈকর চাষ হয়ে থাকে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৩০ রকম ফল চাষাবাদের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। তৈকর একটি অপ্রচলিত ফল এবং রপ্তানিযোগ্য ফলগুলোর মধ্যে অন্যতম। তৈকর ফলটি তারুণ্যে চির সবুজ এবং পরিপক্ক অবস্থায় গায়ে হলুদের শাড়ির মত মন মাতানো রঙ ধারণ করে।
ফলটি আকৃতিগতভাবে উপবৃত্তাকার, চেপ্টা-গোলাকৃতির, আকারে বড় (৭০০-৭৫০গ্রাম) পর্যন্ত হতে পারে। প্রতিটি ফলের দৈর্ঘ্য প্রায় ১০.৩ সেমি এবং প্রস্থ প্রায ৯.২ সেমি। কচি ফলের রং সবুজ, পাকা ফলের রং হলুদ। ফলপ্রতি বীজের সংখ্যা ৪ থেকে ৭ টি পর্যন্ত দেখা যায়। ইংরেজিতে taikor বলা হয়। বৈজ্ঞানিক নাম Garcinia pedunculata যা উদ্ভিদ বিজ্ঞানের Clusiaceae পরিবারের অর্ন্তগত। ভারতের আসামে এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। আসামিরা তৈকর কে bar thakera নামে ডাকে।
সিলেট জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে বহু বছর যাবৎ উৎপাদিত হয়ে আসছে। ফলটি স্বাদে অপ্রধান টক জাতীয়। তরকারিতে টক বা ট্যাংগা হিসেবে এবং আচার, জ্যাম জেলী তৈরি করে খাওয়া হয়। তৈকরের ট্যাংগা দিয়ে মাছের ঝুল সিলেট এবং আসামের জনপ্রিয় একটি খাবার। কচি সবুজ কাচা ফল ফালি ফালি করে কেটে তরকারীতে ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া কুচি কুচি করে কেটে রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা যায়। পাকা ফল সরাসরি খাওয়া যায় তাছাড়া রান্না করেও খাওয়া হয়।
তৈকর মূল্যবান পুষ্টি ও ঔষধিগুণে সমৃদ্ধ একটি প্রাচীন ফল। প্রচুর পরিমান ভিটামিন সি, পটাশিয়াম, জিংক এবং আয়রন সমৃদ্ধ ফল। প্রতি ১০০ গ্রাম তৈকরে এসকরবিক এসিড প্রায় ৮০ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম প্রায় ১২৭ মিলিগ্রাম, সোডিয়াম ৩.৭ মিলিগ্রাম, আয়রন ৭ মিলিগ্রাম এবং জিংকের পরিমাণ প্রায় ১৩.২ মিলিগ্রাম। এ উপকারী ফলটি মানুষের বিবিধ রোগ দূর করার পাশাপাশি মুখে রুচি তৈরি করে। তৈকরের প্রচুর পরিমাণ এসকরবিক এসিড, ফেনলিক এবং ফ্লাবোনয়েড পদার্থ রয়েছে তাই লোক ঔষধ বা folk medicine বলা হয়।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) কর্তৃক ১৯৯৬ সালে মাত্র একটি উন্নত জাত বারি তৈকর-১ উদ্ভাবন করা হয়েছে। তৈকর গাছ থেকে বছরে আমরা ২ বার ফল পেতে পারি। আকৃতিগতভাবে তৈকর গাছটি পিরামিড বা কনিফার আকৃতির। মাঝারি থেকে বড় আকারের হয়ে থাকে। গাছে সারা বছর বড় বড় সবুজ পাতা থাকে । সাধারণত মধ্য-শ্রাবণ থেকে মধ্য-আশ্বিন (আগস্ট-সেপ্টম্বর) মাসে প্রথমবার ফুল আসে এবং দ্বিতীয়বার ফুল আসে মধ্য-মাঘ থেকে মধ্য-ফাল্গুন (ফেব্রুয়ারি) মাসে। প্রথমবার ফল সংগ্রহের উপযোগী হয় মধ্য-কার্তিক থেকে মধ্য-পৌষ (নভেম্বর- ডিসেম্বর) মাসে এবং দ্বিতীয়বার ফল সংগ্রহের উপযোগী হয় মধ্য-চৈত্র থেকে মধ্য জ্যৈষ্ঠ (এপ্রিল-মে) মাসে। ফলের স্বাদ যথেষ্ট টক। গাছ প্রতি ফলের সংখ্যা ৩০০-৩৫০টি। হেক্টর প্রতি ফলন ৭০-৭৫ মে. টন। বৃহত্তর সিলেট জেলায় চাষের উপযোগী। বারি তৈকর-১ জাতটি রপ্তানিযোগ্য।
তৈকরের উৎপাদন প্রযুক্তি
মাটি: বেলে দোআঁশ থেকে পলি দোআঁশ মাটি তৈকর চাষের জন্য উত্তম। সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চলের নিকাশযুক্ত অম্লীয় মাটি তৈকর উৎপাদনের জন্য সর্বোত্তম। তৈকর গাছটি বহুবর্ষজীবি বিধায় অবশ্যই উচু, সরাসরি রৌদ্রযুক্ত ও সুনিকাশযুক্ত এবং পানির উৎসের কাছাকাছি জায়গায় রোপণ করতে হবে।
চারা বা গুটি কলম: ভালো জাত তথা বারি তৈকর-১ জাতের সুস্থ, সবল, রোগমুক্ত চারা বা গুটি কলম নির্বাচন করতে হবে। সরকারি নার্সারী বা বিশ্বস্থ নার্সারি হতে চারা সংগ্রহ করতে হবে। সাইট্রাস গবেষণা কেন্দ্র, জৈন্তাপুর থেকেও চারা সংগ্রহ করা যেতে পারে।
গর্ত তৈরি: চারা রোপণের ১৫-২০দিন পূর্বে গাছ থেকে গাছের দুরত্ব ৬ মিটার এবং সারি থেকে সারি ৬ মিটার দুরত্বে গাছ লাগানোর জন্য জায়গা ঠিক করতে হবে। গাছের চারা রোপণের পূর্বে ১ মিটার প্রস্থ, ১ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১ মিটার গভীর গর্ত তৈরি করতে হবে। গর্তের উপরের মাটির সাথে ১৫-২০ কেজি পরিমাণ জৈব সার, ২৫০ গ্রাম টিএসপি সার, ২৫০ গ্রাম এমওপি সার ও ১০০ গ্রাম জিপসাম সার ভালভাবে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করে তাতে পানি দিতে হবে। হেক্টর প্রতি ২৮৭ টি চারা বা গুটির প্রয়োজন হবে।
চারা রোপণ: সঠিক পদ্ধতিতে ও সঠিক দূরত্বে চারা রোপণের ওপর ভবিষ্যৎ ফলাফল নির্ভর করে। সঠিক দূরত্ব বজায় না রাখলে কাঙ্খিত ফলন আশা করা যায় না। গর্ত তৈরির কমপক্ষে ১০-১৫ দিন পর চারা রোপণ করতে হবে। চারাটি গর্তে সোজা করে লাগাতে হবে ও চারদিকের মাটি হাত দ্বারা চেপে দিতে হবে। চারা লাগানোর পর ঝর্ণা দিয়ে পানি সেচ দিতে হবে। সাথে সাথে খুটি ও বেড়া দিতে হবে। তারপর কয়েকদিন পর্যন্ত দু’একদিন পরপর সেচ দিলে চারা সহজে মারা যায় না।
সার প্রয়োগ: গাছের যথাযথ বৃদ্ধির জন্য সময়মত, সঠিক পরিমাণে এবং সঠিক পদ্ধতিতে সার প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে সারের পরিমাণ বাড়াতে হবে। বয়সভেদে গাছপ্রতি সারের পরিমাণ নিচে দেওয়া হল:
গাছের বয়স (বছর) গোবর সার (কেজি) ইউরিয়া (গ্রাম) টিএসপি (গ্রাম) এমওপি (গ্রাম)
১-২ ৫-১০ ২০০-৩০০ ২০০-৩০০ ২০০-৩০০
৩-৪ ১০-১৫ ৩০০-৪৫০ ৩০০-৪৫০ ৩০০-৪৫০
৫-১০ ২০-২৫ ৪৫০-৬০০ ৪৫০-৬০০ ৪৫০-৬০০
১০-১৫ ২৫-৩০ ৬০০-৭৫০ ৬০০-৭৫০ ৬০০-৭৫০
১৫ এর অধিক ৩০-৪০ ১০০০ ১০০০ ১০০০
উল্লিখিত পরিমাণ সার প্রতি বছর সমান তিন কিস্তিতে বর্ষার আগে ও বর্ষার পরে এবং শীতের পরে গাছে প্রয়োগ করতে হবে। গাছের ডালপালা যে পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে তার নিচের জমি কোদাল দিয়ে হালকা করে কুপিয়ে সার প্রয়োগ করতে হবে। সাধারণত গাছের গোড়ার এক মিটার এলাকায় কোন সক্রিয় শিকড় থাকে না, তাই সার প্রয়োগের সময় গাছের গোড়ায় সার প্রয়োগ করা উচিত নয়। ভূমি ক্ষয় রোধ করার জন্য পাহাড়ী অঞ্চলে ডিবলিং পদ্ধতিতে সার প্রয়োগ করা যেতে পারে।
সেচ প্রয়োগ: শুকনা মৌসুমে ১৫ দিন অন্তর পানি সেচ দেয়া উত্তম। পাহাড়ী অঞ্চলে বর্ষার শেষে মালচিং করা যেতে পারে। এতে মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। মনে রাখতে হবে, সার প্রয়োগের পর পানি সেচ অত্যন্ত জরুরী। জমিতে জো না থাকলে ফুল আসার পর ও ফল মটর দানার সময় গাছে অবশ্যই পানি সেচ দিতে হবে।
অঙ্গ ছাটাই: অঙ্গ ছাটাই ফলগাছ তথা তৈকর গাছের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থাপনা। এতে গাছের আকার, আকৃতি যেমন সুন্দর হয় তেমনি ফলনও বেশি হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে চারা রোপণের দুবছরের মধ্যে পার্শ্বশাখা কেটে দেয়া, চিকন, নরম, রোগা বা দুর্বল শাখা সিকেচার দিয়ে নিয়মিত কেটে রাখলে গাছ বালাইমুক্ত থাকে ও ফলন বেশি হয়। তাছাড়া ফল সংগ্রহের শেষে ফলের বোটা, ছোট শাখা-প্রশাখা ও মরা ডালপালা কেটে দিলে পরের মৌসুমে নতুন শাখা প্রশাখা জন্মায়। এতে গাছ নীরোগ থাকে, ফলনও বেশি হয়।
ফল সংগ্রহ: তৈকর গাছ থেকে বছরে সাধারণত ২ বার ফল সংগ্রহ করা হয়। পরিপক্ক অবস্থায় ফলের রং হলুদে হয়। গাছ প্রতি ফলের সংখ্যা প্রায় ৩০০-৩৫০ টি হয়ে থাকে। হেক্টর প্রতি ফলন ৭০-৭৫ মে. টন হয়।
- Advertisement -
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.