- Advertisement -

ডিজিটাল কৃষক বেলাল

কৃষকের কথা

466

- Advertisement -

 

ডিজিটাল কৃষক বেলাল

কৃষিবিদ মোহাইমিনুর রশিদ

প্যান্ট শার্ট ইন করা, স্মার্ট, সদা হাস্যময়ী এক যুবকের সাথে সাক্ষাত। ভাবতেই ভাল লাগছিল, তিনি একজন আধুনিক স্মার্ট ও ডিজিটাল কৃষক। উপপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, সিলেট মহোদয়ের কার্যালয়ে কৃষি প্রযুক্তি মেলা-২০১৪ উপলক্ষে আলোচনা সভায় প্রথম তার দেখা হয়। মেলার আয়োজনকারী কর্তৃপক্ষ তাকে একটি স্টল বরাদ্দ দিয়েছিলেন। প্রসঙ্গক্রমেই তার ব্যাপারে জানার আগ্রহ বেড়ে গেল। এতক্ষণ কথা বলছিলাম, বঙ্গবন্ধু কৃষি পদক প্রাপ্ত একজন সফল ও আধুনিক কৃষক জনাব বেলাল আহমদ ইমরান এর কথা। সিলেট অঞ্চলের অতি পরিচিত একটি সংলাপ সবাই নাকি লন্ডনে বা প্রবাসী হতে চায়। ব্যতিক্রমী জনাব বেলাল, তাও আবার এই এলাকায় অবহেলিত কৃষিকেই আলিঙ্গন করেছেন পরম মমতায়। কৃষি কাজ করে রুটি রোজগার থেকে আজ তিনি প্রায় কোটিপতি। সম্প্রতি একটি সাক্ষাতকার পর্বে তার সাথে বিশদ আলাপ আলোচনা হয়। আলাপচারিতা কিছু অংশ আপনাদের কাছে উপস্থাপন করলাম।

প্রশ্ন: জনাব বেলাল সাহেব আপনার পরিচয় সর্ম্পকে বলবেন কি?
উত্তর: আমার প্রথম পরিচয় আমি একজন কৃষক। তবে গতানুগতিক নয়, পড়াশুনা জানা আধুনিক শিক্ষিত কৃষক। আমার গ্রামের বাড়ি সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার রামধানা গ্রামে। আমার পুরো নাম বেলাল আহমেদ ইমরান।

প্রশ্ন: পড়াশুনা করে মানুষ চাকুরি করে আর আপনি কৃষিকে কেন বেছে নিয়েছেন?
উত্তর: আমার আত্নীয় স্বজন অনেকেই চাকুরি করে। তবে আমি চাকুরী না করে আধুনিক কৃষি কাজে উৎসাহিত হয়েছি। কারণ আমি একজন উদ্যোক্তা হতে চেয়েছিলাম।

প্রশ্ন: আপনি তো বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক পেয়েছেন?
উত্তর: হ্যাঁ। সিলেট অঞ্চলে আমিই প্রথম দেশী মাছ যথা শিং, মাগুর এর পোনা উৎপাদন ও সিলেট অঞ্চলে ছড়িয়ে দেয়ায় উদ্যোগ গ্রহণ করি। তাছাড়া পাবদা, গোলসা মাছ এর বাণিজ্যিক চাষাবাদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। মূলত শিং মাছের বিস্তৃতি ও প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পুরণ ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে অবদানের জন্য বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরষ্কার ১৪১৮ পেয়েছি। বর্তমানে আমি মৎস্য সেক্টরের পাশাপাশি উচ্চ মূল্যের সবজির প্রতি মনোযোগ বেশি দিচ্ছি।

প্রশ্ন: হঠাৎ উচ্চমূল্যের সবজি উৎপাদনের দিকে মনোনিবেশ করেছেন কেন?
উত্তর: আমি মূলত লাভের পাশাপাশি সৌখিন কৃষি কাজে খুবই আগ্রহী। সিলেট একটি ধনী এলাকা। সিলেট শহরে অনেকগুলো নামী দামী রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সবজি সাভার, নরসিংদী, কুমিল্লা এমনকি সুদূর বগুড়া থেকে আসে। অনেক দামে এগুলো সিলেটের বাজারে বিক্রি হয়। আমি মনে করেছি, উচ্চমূল্যের সবজি চাষ করলে এই সময়ে আমি অধিক লাভবান হব এবং সৌখিন সবজি চাষ করব তাই আমি সবজি চাষের দিকে ঝুকেছি।

প্রশ্ন: উচ্চমূল্যের সবজি বিষয় সর্ম্পকে কোথায় ধারণা পেয়েছেন?
উত্তর: আমি নিজেই উপজেলা পর্যায়ে কৃষি অফিসে মাঝে মাঝে যাই। খোঁজ খবর নিই। তাছাড়া টেলিভিশনে কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখি। শ্যামল সিলেট অনুষ্ঠানটিও মাঝে মাঝে শুনি। এসব অনুষ্ঠান ও কৃষি অফিসের মাধ্যমে উচ্চমূল্যের সবজির সন্ধান পাই। তবে এ ব্যাপারে সরাসরি সহযোগিতা পাই অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম, প্রফেসর, হর্টিকালচার বিভাগ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্যারের। স্যার হাতে কলমে প্রশিক্ষণ ও বীজ দিয়ে আমাকে সহযোগিতা করেছে।

প্রশ্ন: উচ্চমূল্যের সবজি হিসেবে আপনি কি কি সবজি চাষ করেন?
উত্তর: আমি মূলত ক্যাপসিকাম বা মিষ্টি মরিচ ও নাগা মরিচের চাষ করি। তবে ইদানিং অল্প অল্প এসপেরাগাস এর চাষ শুরু করেছি।

প্রশ্ন: ক্যাপসিকাম ও নাগা মরিচ চাষের ব্যাপারে আগ্রহী হলেন কেন?
উত্তর: ক্যাপসিকাম বা মিষ্টি মরিচ ফলটা দেখতেই আমার খুব ভাল লাগে। এটার মধ্যে একটা সৌখিনতা ও আভিজাত্য ভাব রয়েছে। সিলেটের বাজারে দিনে প্রায় ১০০ কেজি ক্যাপসিকামের চাহিদা আছে। দামও প্রচুর প্রায় ১২০ থেকে ২০০ টাকা কেজি। ঢাকার বাজারের একটা জায়গা করে নিতে পেরেছি। আর সিলেটের মানুষ নাগা মরিচ ছাড়া কল্পনাই করতে পারেনা। রাস্তাঘাটে যেখানে একটা আপেল, কমলা বা মাল্টা ফল ১০ থেকে ১৫ টাকা তেমনি সময়তে একটা নাগামরিচের দামও ১০ থেকে ১২ টাকায় বিক্রি হয়। তাই মূলত অর্থনৈতিক লাভের জন্যই ক্যাপসিকাম ও নাগামরিচ চাষ করায় আগ্রহী হয়েছি।

প্রশ্ন: ক্যাপসিকাম চাষ প্রণালীর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি সর্ম্পকে একটু জানতে চাই।
উত্তর: গতানুগতিক অন্যান্য উচ্চমূল্যের সবজি চাষের তুলনায় একটু ব্যাতিক্রম ক্যাপসিকাম চাষ। শুরুতেই ক্যাপসিকামের জাতের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। তাছাড়া ভার্মি কম্পোস্ট, কুইক কম্পোস্ট সার অর্থ্যাৎ জৈব সারের বিকল্প নাই। বীজগুলো শোধন করে নিতে হয়। মাটিকে শোধন করে নিতে হয়। এক্ষেত্রে খড় বিছিয়ে পুড়িয়ে দিলে খুব ভাল হয়। ভালোভাবে চারার যতœ নিতে হয়। ফুল ফল আসা পর্যন্ত গাছের পরিচর্যা করতে হয়। এক্ষেত্রে সঠিক বালাইনাশক নিয়মিত পরিমিত মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে। কারণ গাছে তখন ব্যাপকভাবে পোকা মাকড় ও রোগের আক্রমন হয়। চারা রোপণের ৪০ থেকে ৫০ দিন পর থেকেই ফলন পাওয়া যায়। প্রায় ১০০ দিন পর্যন্ত ফসল তোলা যায়।

প্রশ্ন: গত মৌসুমে কতটুকু জমিতে ক্যাপসিয়াম চাষ করেছিলেন?
উত্তর: ২০১৫ সালে দুই বিঘা জমিতে ক্যাপসিকাম চাষ করেছি।

প্রশ্ন: ক্যাপসিকাম চাষে খরচ, উৎপাদন ও লাভ কেমন হয়েছিল?
উত্তর: দুই বিঘা জমিতে সর্বসাকুল্যে প্রায় ২ লাখ টাকা খরচ হয়। প্রায় ১০,০০০ কেজি ক্যাপসিকাম উৎপাদন হয়। বাজার মূল্য কেজি প্রতি ১২০ থেকে শুরু করে ১৮০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছি। আমার মোট প্রায় ১০ লাখ টাকা বিক্রয় হয়। খরচ বাদে প্রায় ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা লাভ হয়।

প্রশ্ন: ক্যাপসিকাম উৎপাদন করতে গিয়ে কি কি সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন?
উত্তর: ফুল ফল আসা পর্যন্ত পোকা মাকড় ও রোগের প্রার্দুভাব মারাত্বক ক্ষতি করে। আমার ক্ষেত্রেও ঘটেছে বিশেষ করে জাব পোকা ও মাইটের ব্যাপক আক্রমন হয়েছিল।

প্রশ্ন: এসব সমস্যা কিভাবে সমাধান করলেন?
উত্তর: সমস্যা সমাধানে কৃষি বিভাগ এবং অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম স্যারের পরামর্শ মোতাবেক নানাবিধ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। বিশেষ করে মাইট এর ব্যবস্থাপনায় আমি গতানুগতিক কোন কীটনাশক ব্যবহার করিনি বরং সঠিক মাকড়নাশক ব্যবহার করেছি। তাতে আমার খরচ কম হয়েছে। সময়মতো গাছও ভালো হয়েছে। আর জাব পোকা দুরীকরণে শুরুতে ছাই ও পরবর্তীতে সাবান (হুইল পাউডার) মিশ্রিত পানি স্প্রে করেছি। এতে আমার কোন খরচই হয় নাই। আক্রমন বেশি হওয়ার সময় স্যারদের পরামর্শ মোতাবেক কীটনাশক ব্যবহার করেছি।

প্রশ্ন: শুনলাম আপনার ক্যাপসিকাম সবজির জমি দেখতে অনেকেই এসেছিল?
উত্তর: ঠিকই শুনেছেন। ২০১৫ তে আমার ক্যাপসিকাম ক্ষেত পরিদর্শন করতে এসেছেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ১৪০ জন কৃষক, ১২জন কৃষি কর্মকর্তা, জাতীয় পুরুষ্কারপ্রাপ্ত কৃষক, কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিবসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ। তারা আমার থেকে ক্যাপসিকাম চাষের বিভিন্ন কলাকৌশল সম্পর্কে জেনে গেছে।

প্রশ্ন: কৃষি কাজে আপনার পরামর্শ কি?
উত্তর: জানি, কৃষি কাজ ধর্মীয় দৃষ্টিতে সওয়াবের। সেক্ষেত্রে শিক্ষিত বেকারদেরকে প্রথমেই বলব, সিলেটের মাটি সবজি চাষে খুবই উপযোগী। কিন্তু একটু বেশি যত্ন নিতে হয়। বিদেশ প্রীতি বাদ দিয়ে, অলসতা ভেঙ্গে কৃষি কাজে মনোনিবেশ করার প্রতি সকলকে আহবান জানাই।
আপনাকে ধন্যবাদ।
বেলাল সাহেব ইচ্ছে করলে চাকরি করতে পারত। আত্নীয় স্বজনদের মতো লন্ডনে পাড়ি দিতে পারত। তিনি তা না করে বরং কৃষি কাজকেই কর্মের সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছেন। দৃপ্ত সংকল্প নিয়ে মেধা ও শ্রম কাজে লাগিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। বেলাল আহমেদ ইমরানের সাফল্যের পথ অনুসরণ করে দেশের শত শত শিক্ষিত বেকার যুবক নিজেদের সৌভাগ্যের সিঁড়ি রচনায় এগিয়ে আসুক-এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

 

- Advertisement -

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.