- Advertisement -
জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষি
কৃষিবিদ মোহাইমিনুর রশিদ
পাকা ও সুমিষ্ট ফলের মৌ মৌ গন্ধ জ্যৈষ্ঠ মাস জুড়ে বাংলার পথ ঘাট প্রান্তর। আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, তরমুজ, বাঙ্গিসহ নানা রকমের মৌসুমি ফলের সুভাসিত ঘ্রাণে আমাদের সবাইকে মাতোয়ারা করে। আমাদের শরীরের পুষ্টি চাহিদা পূরণের সাথে রঙ্গিন মৌসুমি ফল আমাদের মনকে আন্দোলিত করে। তাছাড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে বিভিন্ন ফলের আচার, চাটনি, জ্যাম জেলি এসব তৈরি করে রাখার সময়ও এই মাস, যা পরবর্তিতে বেশ মজা করে খাওয়া যায়। জ্যৈষ্ঠ মাস মধু মাস, চলুন এই মধুমাসের কৃষিতে করণীয়গুলো জেনে নেই।
মাঠ পর্যায়ে এখন বোরো ধান কাটা প্রায় শেষ পর্যায়ে। যারা দেরিতে বোরো ধান আবাদ করেছিলেন আপনার জমির ধান শতকরা ৮০ পাকা হয়ে গেলে জমির ধান কেটে সংগ্রহ করে ভালোভাবে মাড়াই-ঝাড়াই করে সংরক্ষণ করতে হবে। কারণ যে কোন সময় ঝড়, শিলা বৃষ্টি ও আকস্মিক বন্যার কারণে পাকা ধানের ক্ষতি হতে পারে। ধান কাটার ক্ষেত্রে রিপার মেশিন বা সম্ভব হলে কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহার করলে সময় ও খরচ কম হয়। বীজ ধান সংগ্রহ ও সংরক্ষণের দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। বীজ ধানকে ভালভাবে শুকিয়ে প্লাষ্টিকে ড্রাম, মাটির পাতিল, টিনের ড্রামে বা প্লাষ্টিকের বস্তায় সংরক্ষণ করতে হবে।
আউশ ধানের বীজ ইতোমধ্যে বোনা হয়ে যাওয়ার কথা। না হয়ে থাকলে দেরি না করে এক্ষুণি বপন করে নিন। চারার বয়স ১২-১৫ দিন হলে ইউরিয়া সারের প্রথম কিস্তি হেক্টর প্রতি ৪৫ কেজি ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে পারেন। প্রথম কিস্তি ইউরিয়া উপরি প্রয়োগের ১৫ দিন পর দ্বিতীয় কিস্তি উপরি প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া সারের কার্যকারিতা বাড়াতে জমিতে সার ব্যবহারের সময় ছিপছিপে পানি রাখ এবং আগাছা মুক্ত রাখা জরুরি। রোপা আউশের বেলায় গুড়া ইউরিয়ার পরিবর্তে গুটি ইউরিয়া ব্যবহার করতে পারেন। কারণ সারের অপচয় কম হয় বলে ২৫ ভাগ সার কম লাগে, ফলনও বেশি হয়। চারটি ধানের গুছির মাঝখানে ২টি গুটি ব্যবহার করতে হবে। গুটি ইউরিয়া ব্যবহার করা হলে ২৫-৩০ দিনের মধ্যে জমিতে নামা যাবে না।
আপনার আউশ ও বোনা আমন জমিতে পোকার আক্রমণ দেখা দিতে পারে, বিশেষ করে পামরী পোকা। পামরী পোকা ও কীড়া পাতার সবুজ অংশ খেয়ে গাছের বেশ ক্ষতি করে থাকে। পামরী আক্রমণের প্রথম পর্যায়ে সতর্ক থাকলে হাতজাল, মশারি এসব দিয়ে প্রাথমিকভাবে পোকা ধরে মেরে ফেলা যায়। তাছাড়া আক্রান্ত গাছের গোড়া থেকে ৫ সে.মি অর্থাৎ ২ ইঞ্চি পরিমাণ রেখে বাকী অংশ কেটে কীড়া ও পোকা ধ্বংশ করা যায়। প্রতিটি ধানের গোছায় যদি ৪টি বয়স্ক পামরী বা প্রতিটি পাতায় ১৫টি কীড়া দেখা গেলে বুঝতে হবে আক্রমণ ব্যাপক হয়েছে। তখন সঠিক মাত্রায় অনুমোদিত কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। কীটনাশক ব্যবহার করা হলে সতর্কতার সাথে ব্যবহার করতে হবে।
জ্যৈষ্ঠ মাসেই রোপা আমন ধানের বীজতলা করতে পারেন। উঁচু রৌদ্রোজ্জ্বল জমি ভালভাবে চাষ ও মই দিয়ে থকথকে কাদাময় করে নিতে হবে। ভাল মানের চারা পাওয়ার জন্য প্রতিটি বীজতলার বেড জমির মাপ অনুযায়ী লম্বা এবং প্রস্থে ১২০ সে.মি অর্থাৎ ৪ ফুট রাখতে হবে। বীজতলার উচ্চতা অন্তত ১৫ সে.মি (৬ ইঞ্চি) উঁচু রাখতে হবে। সেচ নিকাশসহ প্রয়োজনীয় পরিচর্যার জন্য বীজতলার বেডের চারদিকে ৪৫ সে.মি (১.৫ ফুট) চওড়া নালা রাখতে হবে। জমি উর্বর হলে সাধারণত কোন সারের প্রয়োজন হয় না। প্রতি বর্গমিটার জমির জন্য ৮০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়।
জমি অনুর্বর হলে বীজতলার মাটির সাথে জৈব সার মিশালে ভাল হয়। বীজতলায় বীজ বোনার আগে একস্তর ছাই ছিটিয়ে দিলে চারা তোলার সময় উপকার পাওয়া যায়। সুস্থ সবল চারা ভাল ফলনের জন্য প্রাথমিক নিশ্চয়তা তাই যতœ এবং সতর্কতার সাথে বীজতলা পরিচর্যা করুন সুস্থ সবল চারা উৎপাদন করুন।
এসময়ে আপনার পাট ক্ষেতের জমির আগাছা পরিস্কার, ঘন হলে দূর্বল চারাটি তুলে ফেলা, ইউরিয়া সারের উপরি প্রয়োগ করা, মাটিতে রস না থাকলে সেচ দেয়া এবং পানি জমে থাকলে নিকাশের ব্যবস্থা করা দরকার। পাটের শাক সুস্বাদু ও পুষ্টিকর, সুতরাং নিড়ানি দিয়ে অতিরিক্ত পাটের চারা তুলে ফেলে না দিয়ে শাক হিসেবে খেতে পারেন। বিছা পোকা পাটের জমিতে আক্রমণ করতে পারে। ডিমের গাদা এবং পাতার নিচের ছোট কীড়ার দল সংগ্রহ করে মেরে বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। পাট ক্ষেতে বাঁশের কঞ্চি বা ডাল পালা পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করে দিলে পাখি পোকা খেয়ে ফেলবে। এতে পোকার আক্রমণ অনেক কমে যাবে। আক্রমণ খুব বেশি হলে অনুমোদিত কীটনাশক সঠিক মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে।
এখন মাঠে বা বসতবাড়ির আঙ্গিনার গ্রীষ্মকালীন শাকসবজির পরিচর্যা করা জরুরি। শাকসবজির জমিতে সারের উপরিপ্রয়োগ, আগাছা পরিস্কার, গোড়ায় মাটি তোলে দেয়া, লতাজাতীয় সবজির মাচাতুলে দেয়ার কাজ করতে হবে। লতা জাতীয় সবজির বাড়-বাড়তি বেশি হলে কিছু কিছু (১০-১৫%) লতা বা পাতা কেটে ছাঁটাই করে দিতে হবে। আশা করা যায় ছেঁটে দিলে তাড়াতাড়ি এবং বেশি ফল ধরবে। শাক সবজিতে যদি কীটনাশক ব্যবহার করতেই হয় তবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে বিষের প্রভাব ৩-৪ দিনের বেশি থাকে সেসব কীটনাশক ব্যবহার করা না হয়। কুমড়া জাতীয় সবজির হস্ত পরাগায়ন নিয়মিত করবেন দেখবেন ফলন ভাল হয়েছে।
বছরে দু’বার গাছপালায় সার ব্যবহার করতে হয়। বর্ষার আগে একবার এবং বর্ষার পরে একবার। বর্ষার আগে এখনই গাছের গোড়ায় সার প্রয়োগের উপযুক্ত সময়, দেড়ি না করে এখনই সার প্রয়োগ করে নিন। নতুন করে ফলজ, ওষুধি বা বনজ গাছের চারা রোপণ করতে চাইলে নির্ধারিত স্থানে গর্ত করে জৈব ও রাসায়নিক সার দিয়ে গর্ত ভরাট করে রাখুন। ৭-১০ দিন পর চারা রোপণ করতে পারেন।
বর্ষা আসার আগেই গবাদিপ্রণির বাসস্থান সংস্কার বা মেরামত করুন এবং ঘরের আশপাশ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করুন। বর্ষায় যাতে প্রাণি-খাদ্যের অভাব না হয় সে দিকে খেয়াল রাখুন। প্রয়োজনে প্রাণিরর খাদ্য সংরক্ষণ করুন। বর্ষার আগে অবষ্যই আপনার গরু-বাছুরকে প্রয়োজনীয় টিকা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এসময়ে গবাদিপ্রাণিকে নিয়মিত গোসল করাতে হবে এবং ঠান্ডা স্থানে রাখতে হবে। হাঁস-মুরগির বেলায়ও নিয়মিত ভ্যাক্সিন দেয়ার ব্যবস্থা করুণ এবং সুষম খাদ্য খাওয়ান।
এখন মাছের প্রজননের সময়। মাছ চাষের জন্য যারা হ্যাচারি করেছেন এবং ডিম থেকে পোনা করবেন তারা এ সময়ে বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে। আঁতুর পুকুরের পোনা আঙ্গুলের সমান লম্বা হলে চারা পুকুরে ছাড়ার ব্যবস্থা নিন। বর্ষার আগে পুকুর পাড়ের সংস্কার করে নিন।
- Advertisement -
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.