খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার
খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার
- Advertisement -
খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার
কৃষিবিদ মোহাইমিনুর রশিদ
খাদ্য নিরাপত্তা
খাদ্য মানুষের মৌলিক অধিকার। এ মৌলিক অধিকার রক্ষা তথা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রতিটি রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। খাদ্যের প্রাপ্যতা, প্রবেশাধিকার ও পুষ্টির সামগ্রিক রুপকে বলা হয় খাদ্য নিরাপত্তা। খাদ্য নিরাপত্তা বলতে একটি দেশ, সমাজ বা পরিবারের প্রত্যেকটি মানুষের কর্মক্ষম ও সুস্থ জীবন পরিচালনার জন্য চাহিদা ও পছন্দ অনুযায়ী সব সময়ে যথেষ্ট পরিমাণ নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা থাকাকে বুঝায় (এফএও)। সুতরাং, খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি শুধুমাত্র ভাত-প্রাপ্তির নিশ্চয়তা, তথা চাল বা ধান উৎপাদনে কোনো দেশের স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্জনকে না বিবেচনা করে, পুষ্টি সরবরাহকারী সকল ধরনের খাদ্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তাকেও বুঝিয়ে থাকে। খাদ্য নিরাপত্তা হলো এমন এক অবস্থা, যখন খাদ্যের যথেষ্ট মজুদ থাকবে, মানুষের কাছে সে খাদ্যের সহজপ্রাপ্যতা থাকবে এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে সে খাদ্য পাওয়া যাবে। কাজেই খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও আয় বৃ্দ্িধ এবং যথাযথ পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা খাদ্য নিরাপত্তার অন্যতম শর্ত।
বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তার অবস্থান
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় এর জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৭ (সাত) কোটি। তারপরও খাদ্য ঘাটতি ছিল প্রায় ১৫ লাখ মেট্রিক টন। সময়ের সাথে জনসংখ্যা দ্বিগুনেরও বেশি, আশংকাজনকহারে জমির পরিমাণও কমেছে তারপরও দানাদার শস্যখাদ্য তথা চাল উৎপাদনের আজ আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিদেশেও রপ্তানি করছি। কৃষক-ক্ষেতমজুর, কৃষিবিদ ও কৃষিবিজ্ঞানীদের একান্ত চেষ্টার ফলে বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে এ অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। সবচেয়ে অবাকের বিষয় হলো, ধান উৎপাদনে বিশ্বে আমরা চতুর্থ, সবজি উৎপাদনে ৩য়, আলু উৎপাদনে ৭ম, আম উৎপাদনে ৮ম, ছাগল উৎপাদনে ৪র্থ, মাছ উৎপাদনে ৪র্থ। তারপরও আমাদের আত্মতুষ্টির কোন সুযোগ নেই, কেননা আমরা এখনও পুষ্টি ও গুণগতমানের খাবার উৎপাদন ও গ্রহণে অনেক পিছিয়ে আছি। তাছাড়া আমরা এখনও খাদ্য অভ্যাস পরিবর্তন করতে পারিনি। খাদ্য নিরাপত্তায় শস্য খাদ্যে আজ আমরা একটা শক্তিশালী পর্যায়ে কিন্তু পুষ্টি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। সুস্বাস্থ্যের জন্য জনপ্রতি আমাদের প্রতিদিন প্রায় ২৫০ গ্রাম শাকসবজি, ১২৫ গ্রাম ফল, প্রায় ৫০ গ্রাম প্রোটিন, ৩৫ থেকে ৪০ গ্রাম শর্করা, ২৫ থেকে ৩০ গ্রাম আশ, ১ চা চামচের নিচে আয়োডিনযুক্ত লবন খাওয়া দরকার। অথচ আমরা প্রতিদিন গড়ে মাত্র ৭০ থেকে ৮০ গ্রাম শাকসবজি, ৪০ থেকে ৪৫ গ্রাম ফল, ১৫ গ্রাম শর্করা আহার করার সুযোগ পেয়ে থাকি।
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার
ফসলের উন্নত জাত প্রযুক্তি: উচ্চফলনশীল জাতের ধান যেমন, ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান২৯, ব্রি ধান৫৮, ব্রি ধান৪৮, ব্রি ধান৪৯ সহ আরো গুরুত্বপূর্ণ ধানের জাতগুলোর ব্যবহারে আজ বাংলাদেশ শস্য ফসলে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাছাড়া গম, ভুট্রা সহ শাকসবজি চাষে কৃষক হাইব্রিড জাতের বীজ ব্যবহার করে ফসল উৎপাদনে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে দিয়েছে। ফসলের জাতের যুগান্তকারী আবিস্কার যেমন রোগ ও পোকা প্রতিরোধী জাত যা ফসল উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
সুষম সারের ব্যবহার: মাটির স্বাস্থ্যের প্রতি লক্ষ্য রেখেই জৈব সারের ব্যবহার বৃদ্ধি এক্ষেত্রে কম্পোস্ট সার, ভার্মিকম্পোস্ট এবং কুইক কম্পোস্ট খুবই কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে। তাছাড়া কৃষকেরা মাটি পরীক্ষা করে সার প্রয়োগ করছে। ফলে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা হচ্ছে। অন লাইন ফার্টিলাইজার সুপারিশ সহ উপজেলা সার নির্দেশিকা প্রযুক্তিগুলো কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কৃষি কর্মীর মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে। ফলে ফসলের উৎপাদন বাড়ছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে। সার ব্যবহারে গুটি ইউরিয়ার ব্যবহার, ডিএপি সারের ব্যবহার বৃদ্ধি, এমওপি সারের ব্যবহার বৃদ্ধি, এলসিসি প্রযুক্তিগুলো মাঠে খাদ্য উৎপাদনে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করছে।
পানি ব্যবস্থাপনা: এডাব্লিউডি পদ্ধতি, সম্পূরক সেচ সহ বিভিন্ন প্রযুক্তিগুলো পানির অপব্যবহার রোধের পাশাপাশি, উৎপাদন বাড়াচ্ছে।
মাঠ পর্যায়ে কৃষির আধুনিক কৃষি প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে ফসল উৎপাদনে আইপিএম কৌশল-জৈবিক বালাই ব্যবস্থাপনা-ভেষজ বালাইনাশক ব্যবহার, উপকারি পোকামাকড় সংরক্ষণ ও বৃদ্ধিকরণ, আইল ফসল চাষাবাদ; বালাইসহনশীল জাত ব্যবহার করা হচ্ছে। আধুনিক কৃষি চাষাবাদ ব্যবস্থাপনা যেমন ভালো বীজ ব্যবহার, বীজ শোধন, আদর্শ বীজতলা তৈরি, মাটি শোধন করা, সেক্স ফেরোমন ট্রেপ ও বিষটোপ ব্যবহার, সার ব্যবস্থাপনা, আগাছা ব্যবস্থাপনা, পানি ব্যবস্থাপনা, সঠিক সময়ে ফসল মাড়াই করা এসব প্রযুক্তিগুলো নিয়মিতই মাঠ পর্যায়ে কৃষকেরা ব্যবহার বাস্তবায়ন করছে; তাছাড়া যান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা যেমন হাত জাল, আলোক ফাদ এসব মেনে চলা, অবশেষে বালাইনাশকের যুক্তিসম্মত ব্যবহার অর্থ্যাৎ সঠিক বালাইনাশক নির্বাচন, সঠিক মাত্রায় সঠিক সময়ে ও সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করে বালাইনাশক স্প্রে করা হচ্ছে তাই ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে ।
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সরকারের পদক্ষেপ
দেশে ফসল কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
১. টেকসই কৃষি প্রযুক্তি ও জাত উদ্ভাবনে কৃষি শিক্ষা, কৃষি গবেষণা ও কৃষি সম্প্রসারণে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। পাটের জিনোম আবিষ্কার ও ছত্রাকের জীবন রহস্য উন্মোচনে বিশেষ সহায়তা প্রদান। উৎপাদন খরচ কমানোর সার, জ্বালানি ও সেচ কাজে বিদুতের ভর্তুকি প্রদান। খামার যান্ত্রিকীকরণে ভর্তুকি প্রদান। কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড প্রদান । ফসল উৎপাদনে কৃষি প্রণোদনা ও কৃষি পুনর্বাসন কাযর্ক্রম চালু। ১০ টাকায় কৃষকের ব্যাংক একাউন্ট খোলা। বর্তমান সরকার ক্ষুদ্র সেচ কার্যক্রম জোরদার করেছে। ড্যাম, পাহাড়ে ঝিরি বাঁধ, রাবার ড্যাম ইত্যাদি নির্মাণ করা হয়েছে।
২. কৃষি পণ্যের বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন বর্তমান সরকারের আরেকটি সাফল্য। পাইকারি বাজার সৃষ্টি, গ্রোয়ার্স মার্কেট, কুল চেম্বার স্থাপন, রিফার ভ্যান পণ্য বিপণন, নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি ইত্যাদি
৩. সরকার অঞ্চলভিত্তিক ১৭টি সমন্বিত কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এসব উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে এলাকা উপযোগী ফসলের জাত উন্নয়ন, সম্ভাবনাময় কৃষি প্রযুক্তি সম্প্রসারণ, সেচ অবকাঠামো নির্মাণ করে সেচের আওতা বৃদ্ধি করা, কৃষিজাত পণ্যের বাজার সুবিধা বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছে।
৪. পতিত জমি চাষাবাদের আওতায় আনার কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।
৫. দেশের সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার কৃষির সার্বিক উন্নয়ন সাধনের জন্য ২০১৩ সনে একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এ মহাপরিকল্পনার আওতায় দক্ষিণাঞ্চলের ১৪টি জেলায় সামগ্রিকভাবে ফসল, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতসহ ১০টি প্রধান ক্ষেত্রে কর্মকা- শুরু হয়েছে।
৬. দেশে বর্তমান সরকারের আমলে ডিজিটাল কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে।
৭. দেশে মাটির উর্বরতা অনুযায়ী অনলাইন সুষম সার সুপারিশ করার জন্য ২০০টি উপজেলায় ডিজিটাল পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। তাছাড়া দেশে এইজেড ভিত্তিক মডেলিংয়ের মাধ্যমে ১৭টি শস্য উপযোগিতা বিষয়ক ম্যাপ প্রণয়ন করা হয়েছে।
- Advertisement -
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.