- Advertisement -
কোরবানির পশু: কেনার আগে একটু ভেবে নিন।
কৃষিবিদ মোহাইমিনুর রশিদ
মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন, নৈকট্য লাভ ও ত্যাগের শিক্ষা প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে প্রিয়বস্তু বা প্রিয়প্রাণি উৎসর্গের নামই কোরবানি। শরিয়তের পরিভাষায় মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট সময়ে সুনির্দিষ্ট পশু জবাই করাকে কোরবানি বলে (শামি ৫ম খন্ড)। ইসলামি শরিয়াহ মোতাবেক ছয় ধরনের পশু দ্বারা কোরবানি আদায় করার তাগিদ রয়েছে। এগুলো হলো ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, গরু, মহিষ এবং উট। সুন্দর, আকর্ষণীয়, প্রিয় ও অতি পছন্দনীয় পশু কোরবানির মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জন করা যায়।
কোরবানির পশু নির্বাচন বিষয়ক কিছু অবতারণা
প্রথমেই পশুদের বয়স একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ বিষয়ে ইসলামি শরিয়াতে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। ছাগল, ভেড়া ও দুম্বার জন্য কমপক্ষে এক বছর; গরু ও মহিষের জন্য নুন্যতম দুই বছর এবং উটের বয়স কমপক্ষে পাঁচ বছর হতে হবে। তাছাড়া কোরবানির পশুগুলো হতে হবে যথাসম্ভব দোষ ও ক্রুটিমুক্ত। এক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়গুলো হলো- সাধারণত মধ্যম বয়সী, উজ্জ্বল গাঢ় বর্ণের, আকর্ষণীয় ও দর্শকনন্দিত, পরিশ্রান্ত বা ক্লান্ত না হওয়া এবং সুস্থ ও নিঁখুত হতে হবে। এ ব্যাপারে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স:) বলেছেন স্পষ্টত অন্ধ, মারাত্নক অসুস্থ, দুর্বল হাড্ডিসার এবং চারপায়ে চলতে অক্ষম বা খোঁড়া এমন পশু কোরবানি করা যাবে না। পবিত্র হাদিসে ত্রুটিমুক্ত পশু প্রসঙ্গে বিস্তারিত ধারনা পাওয়া যায়। আলোচনার উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো হলো- দু’চোখ বা এক চোখ এক তৃতীয়াংশের বেশি অন্ধ পশু কোরবানি চলবে না, তিন পায়ে চলে বা চার পায়ে ভর দিতে পারে না এমন পশু কোরবানি করা বৈধ নয়, পশুর কান বা লেজ এক তৃতীয়াংশের বেশি কাটা থাকলে কোরবানি হবে না, মজ্জা শুকিয়ে গেছে এমন হাড্ডিসার পশুতে কোরবানি হবে না, শিং উঠেইনি অথবা শিং অগ্রভাগ বা সামান্য ভাঙ্গা হলে চলবে তবে শিং যদি মূল থেকে ভেঙ্গে থাকে তাতেও কোরবানি শুদ্ধ হবে না, যেসব পশুর চামড়া-পশম নষ্ট বা চর্মরোগের কারণে গোশত ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এমন পশু কোরবানি করা যাবে না। ইবাদত ক্রটিমুক্ত হওয়া জরুরি। কোরবানি একটি উচ্চমর্যাদার ইবাদত।
কোরবানির জন্য সুস্থ পশু চেনার উপায়
কোরবানির জন্য বয়সের ব্যাপারটি অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। সুস্থ পশু চেনার সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য হলো মাথা তথা শিরদাড়া উঁচু, কান খাঁড়া, শরীর টানটান থাকবে। পশুগুলোর মধ্যে প্রাণোচ্ছ্বল ও প্রাণচাঞ্চল্যপূর্ণ চটপটে ভাব থাকবে, দ্রত হাঁটাচলা ও স্বাভাবিকভাবে খাওয়া-দাওয়া করবে। ভারি আওয়াজে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে থাকবে এমনকি গুঁতো দিতেও উদ্যত হবে। পশুর মুখের সামনে কিছু খাবার বা ঘাস দিলে নিজ থেকেই জিব দিয়ে টেনে নিয়ে খাবার খেতে থাকে তাহলে পশুটি সুুস্থ। সুস্থ সবল পশুরা লেজ নাড়িয়ে শরীরের মাছি তাড়ায়। এক স্থানে স্থির হয়ে দাড়িয়ে থাকতে চায় না, কান নাড়াচাড়া করে, পশুর কাছে গেলে অনেক সময় গুতা দেওয়ার চেষ্টা করে, সুস্থ পশুর নাকের উপরটা ভেজা ভেজা থাকে। সুস্থ পশু বিশেষ করে গরুর ক্ষেত্রে পিঠের কুঁজ/গজ মোটা ও টান টান হয়ে থাকে। তবে মোটাতাজা পশু মানেই সুস্থ এমনটা নয় বরং বেশি মোটাতাজা পশুতে চর্বির পরিমাণ বেশি থাকে যা পরবর্তীতে মানুষের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। কোরবানির পশু কেনার আগে পশুর শরীরের কোথাও ক্ষত আছে কিনা ভালোভাবে পরীক্ষা করে নিন। বিশেষ করে শিং ভাঙ্গা আছে কিনা, লেজ, মুখ, দাঁত, খুর এসব কিছুই পরীক্ষা করে দেখুন, কোন ত্রুটি চোখে পড়ে কিনা। অন্যদিকে স্থির হয়ে দাড়িয়ে থাকা, ঝিমানো, চোখের পাতা সাদাটে বর্ণের, মোটাতাজা পশুর শরীরে হাতের আঙ্গুলে চাপ দিলে ডেবে যাওয়া ও পূর্বাবস্থায় ফিরে আসতে যথেষ্ট সময় লাগলে এসব পশু না কেনার পরামর্শ রইল। তবে পশু কেনার সময় ওজনে ভারি, ফোলা ও চর্বিজাতীয় পশু না কেনাই উচিত।
গ্রোথ হরমোন বা স্টেরয়ড বিষয়ক আলোচনা
ইসলামে নির্দেশনা রয়েছে মোটাতাজা সুন্দর পশু কোরবানি করার। তাই আমরা মোটাতাজা পশু কোরবানি করতে উৎসাহিত বোধ করি। তবে অপ্রিয় হলেও সত্য যে, ঈদের আগে অধিক মুনাফা লাভের আশায় অনেকেই বিভিন্ন অনৈতিক পন্থায় পশু মোটাতাজা করে থাকে। এক্ষেত্রে গ্রোথ হরমোনের ব্যবহার, ট্যাবলেট ও স্টেরয়েডসহ নানা ধরনের বিষাক্ত ইনজেকশন ব্যবহার করে গবাদিপ্রাণিকে মোটাতাজা করে থাকে। এটা একেবারেই নিষিদ্ধ এবং অত্যন্ত গর্হিত কাজ। মৎস্য ও পশুসম্পদ আইন ২০১০ মোতাবেক পশুকে অ্যান্টিবায়োটিক বা ক্ষতিকর স্টেরয়েড খাওয়ানো যাবে না এবং দন্ডনীয় অপরাধ।
অধিক মুনাফা লাভের জন্য অনেক খামারিরা কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে অনৈতিকভাবে পশু মোটাতাজা করে থাকে। প্রতি বছরই কৃত্রিমভাবে পশু মোটাতাজাকরণের জন্য এক শ্রেণীর খামারি ঈদের কিছুদিন আগে রোগাক্রান্ত ও শীর্ণকায় পশু অল্প টাকায় কিনে স্টেরয়েড বড়ি, ইউরিয়া ও নিষিদ্ধ পাম বড়িসহ বিভিন্ন ওষুধ খাওয়ানো এবং স্টেরয়েড ইঞ্জেকশন প্রয়োগের মাধ্যমে পশু মোটাতাজা করে। এসব গ্রোথ হরমোন ব্যবহারের ফলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পশুর ওজন বেড়ে যায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত। ফলে পশুকে দেখতে মোটাতাজা ও শরীরে মাংসের পরিমান বৃদ্ধি পায় বলে মনে হয়। অথচ এসব স্টেরয়েড ওষুধ ব্যবহারের নানাবিধ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে। দীর্ঘদিন স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ ব্যবহারে প্রাণীটির স্বাস্থ্য ঝুঁকির পাশাপাশি এ ধরনের মাংস খাওয়া মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি ও ক্ষতিকর। স্টেরয়েড ব্যবহারে প্রাণীর শরীরে ড্রামাটিক পরিবর্তন আসে যেমন দেহের আয়তন অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। দেহের চর্বি কোষগুলো বৃদ্ধি পায়। অপরদিকে পশুর হৃৎপিন্ড, কিডনি, অগ্নাশয় ও যকৃৎ মারাতœক ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে যায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। অনেক সময় এসব ওষুধ সেবনে পশুর হার্ট এ্যাটাক হয়ে মারাও যেতে পারে। এই জাতীয় পশুর গোশত যদি মানুষ নিয়মিত গ্রহণ করেন, তাহলে মানুষের শরীরের বিভিন্ন ধরনের রোগের আর্বিভাব ঘটে যেমন উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হƒদরোগ এমনকি ব্রেন স্ট্রোকও হতে পারে।
ক্ষতিকারক হরমোন খাওয়ানো মোটাতাজা পশু চেনার উপায়
গ্রোথ হরমোন বা স্টেরয়েড ব্যবহৃত পশুর শরীরে পানি জমে মোটা হয়ে যায়, পানি জমে থাকা থলের মতো থলথল করে। এসব পশুর পেছনের দিকে ঊরুর পেশীবহুল জায়গায় আঙ্গুল দিয়ে চাপ দিলে তা কিছুটা দেবে যাবে। তুলনামুলকভাবে এসব গরুর পাগুলো অনেক পাতলা বা শুকনো মনে হয়। পশুগুলো অস্বাভাবিক মোটা হয়ে যায়, ফলে শারিরীক দুর্বলতা ও অসুস্থতার কারণে সবসময় নীরব ও নির্জীব থাকে, নড়াচড়া কম করে। তাছাড়া ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারে না, এমনকি খাবারও খেতে চায় না।
আরোও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
কোরবানির পশুর হাটে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় অনেকেই, দূরদুরান্ত থেকে কোরবানির পশুর মাঠে পশুগুলোকে দু তিন দিন আগেই নিয়ে আসেন। তাছাড়া পশুগুলোকে বিক্রি করতে গেলেও অনেক সময় বেশ কয়েকদিন সময় লেগে যায়। এমতাবস্থায় নতুন পরিবেশে পশুগুলো খেতে চায় না। তাই অনেক ব্যবসায়ী জোড় করে বাঁশের চোঙ্গা দিয়ে খাবার দিয়ে থাকেন। ফলে অনেক সময় হজম জটিলতার কারণে পশু মারা যেতে পারে। এজন্য পশুগুলোকে পরিমিত মাত্রায় দানাদার খাবার, ঘাস জাতীয় খাবার ও পরিষ্কার পানি খেতে দিতে পারেন। আবার কোরবানি পশু ক্রয় করে সুনির্দিষ্ট একটা জায়গায় রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ দিতে হবে। পরিষ্কার পানি, দানাদার খাবার ও ঘাস খাওয়াতে হবে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। কোরবানির ১২ ঘন্টা আগে খাবার বন্ধ করে দেয়াই উত্তম। পরিষ্কার পানি দিয়ে গোসল করিয়ে, পরিচ্ছন্ন জায়গায় কোরবানির ব্যবস্থা করতে হবে। তবে হ্যাঁ, কোরবানি দেয়ার পর রক্ত ও ময়লা আবর্জনা ফেলার জন্য গর্ত প্রস্তুত ও ব্যবস্থা আগেই করে নিতে হবে। পাশাপাশি মুল্যবান সম্পদ চামড়া সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনার দিকেও একটু বিশেষ নজর দেয়ার তাগিদ রইল। তাতে পরিবেশ দূষণসহ নানাবিধ দুভোর্গের হাত থেকে আপনি সহজেই রক্ষা পাবেন।
সর্বোপরি এককথায় বলতে চাই পশুকে প্রাকৃতিক উপায়ের সাথে বিজ্ঞানের সমন্বয়ে হৃষ্টপুষ্ট করুন। সাধারণত খড়, তাজা ঘাস, খৈল ও ভুষিসহ পুষ্টিকর খাবার দেয়াই যথেষ্ট। স্টেরয়েড ব্যবহার অনৈতিক, গর্হিত ও দন্ডনীয় কাজ, তাই এসব ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন। মোটকথা সুস্থ, সুন্দর, সবল, আকর্ষনীয়, চটপটে পশুটি কোরবানির জন্য নির্বাচন করুন। বেশি দামের জৌলুস ও অহমিকায় নয় বরং নৈতিক মননশীলতার মাধ্যমে মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভই হউক আপনার কোরবানির মূল লক্ষ্য।
- Advertisement -
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.