- Advertisement -

বাংলার কৃষি ও কৃষকের আস্থা: শেরে বাংলা

বাংলার কৃষি ও কৃষকের শেরে বাংলা

2,611

- Advertisement -

 

বাংলার কৃষি ও কৃষকের আস্থা: শেরে বাংলা
কৃষিবিদ মোহাইমিন
কৃষি ও কৃষকের প্রতি কতটুকু ভালবাসা, মমত্ববোধ, উদারতা থাকলে পার্টির নাম হয় কৃষক প্রজা পার্টি, পরবর্তীতে কৃষক শ্রমিক পার্টি। পার্টির প্রতীক কৃষকের বন্ধু “লাঙ্গল”। “লাঙ্গল যার জমি তার, ঘাম যার দাম তার” শ্লোগানের সাথে মিশে আছে কৃষক প্রজা পার্টির ইতিহাস। বলছিলাম কৃষক প্রজা পার্টির নেতা হক সাহেবের কথা। তিনি আর কেউ নন, তিনিই শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক।
বাংলাদেশের অন্যতম স্থপতি শের-এ-বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক একাধারে ছিলেন বাঙালি বলিষ্ঠ রাজনীতিবিদ, আইনজীবি, অধ্যাপক, সরকারি চাকুরীজীবি, সম্পাদক এবং পুরোদস্তর কৃষি-কৃষক চিন্তাবিদ। রাজনৈতিক মাঠ এবং সাধারণ গণ মানুষের নিকট শের-এ-বাংলা (বাংলার বাঘ) এবং হক সাহেব নামে পরিচিত ছিলেন। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি কলকাতার মেয়র, অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী, পূর্ব পাকিস্থানের প্রধানমন্ত্রী, পাকিস্থানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পূর্ব পাকিস্থানের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেছেন। যুক্তফ্রন্ট গঠনে প্রধান নেতাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অনন্য।
বাংলার কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে শেরে বাংলার রয়েছে এক বর্ণাঢ্য সংগ্রামী কাহিনী। বাংলার রাজকীয় রাজনীতির ¯্রােতে কৃষকের রাজনীতিকেও মূল ধারায় তিনি নিয়ে এসেছিলেন। কৃষকের কল্যাণে কাজ করার জন্য তিনি কৃষক রাজনীতি করেছেন। বাংলার মেহনতী কৃষকদের উন্নতি সাধনই ছিল কৃষক রাজনীতির মূল লক্ষ্য। এ জন্য তিনি নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি দল গঠন করেছিলেন। তিনিই সমিতিটির প্রথম সভাপতি ছিলেন । বঙ্গ প্রজা সমিতির রেশ ধরেই পরবর্তীতে কৃষক প্রজা পার্টির সূত্রপাত ঘটে।
সাব ডিভিশনাল অফিসার (এস. ডি. ও) পদে চাকুরির সুবাদে তিনি জামালপুর মহকুমাতে চাকরি করেন। সে সময় তিনি নিজের চোখে মেহনতী কৃষক শ্রমিকের ওপর জমিদার ও মহাজনের নিষ্ঠুর নির্মম অত্যাচার, লাঞ্জনা, নিপীড়ন অবলোকন করেন। এসব অত্যাচারের প্রতিকার করতে বার বার বাস্তব রুঢ় সত্যের মুখোমুখি হয়ে নানাবিধ অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। পরবর্তীতে সমবায় দপ্তরের সহকারী রেজিস্ট্রার পদে চাকুরীরত অবস্থায়ও কৃষক শ্রমিকের বাস্তব দুর্দশা নিজের চোখে পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি বহুবার প্রতিবাদও করেছেন। কৃষকপ্রজা সাধারণ সম্মেলন করেছেন। সারা দেশের আপামর কৃষক জনতাকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ের আন্দোলন পরিচালনা করেছেন। তারপর সেই অভিজ্ঞতার আলোকে পরবর্তীতে তিনি বাংলার কৃষক প্রজাদের মহাজনের অত্যাচার, অনাচার ও শোষণের রাহুমুক্ত করতে মহাজনী আইন পাশ করেন। ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় পাল বংশ, সেন বংশ, সুলতানি এমনকি মোঘল আমলেও জমির মালিকানা ছিল স¤্রাটদের আওতায়। কৃষক সমাজ ছিল এক প্রকার ভূমিদাস। তাদের কোন সামাজিক স্বীকৃতি ছিলনা। অত:পর ইংরেজদের আমলেও জমির মালিক ছিল মূলত জমিদারেরা। সহ¯্র বছরের সামন্ত প্রথাকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়ে কৃষকদের জমির মালিক করে দেয়ার সুযোগ তৈরি করে দেন শেরে বাংলা। তৎকালীন সময়ে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা ছিল কৃষকের সময়মত ঋণ নিয়ে। শেরে বাংলা শত শত সমবায় সমিতি সৃষ্টি করে কৃষকদের জন্য ঋণরে ব্যবস্থা করনে। তনিি খাজনার দায়ে জমি বক্রি,ি র্সাটফিকিটে প্রথা এসব রহতি করনে। পরর্বতীতে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রসিভার আমলে তনিি কৃষি ঋণ মওকুফ করনে। শেরে বাংলার নির্দেশেই ৬০ হাজার ঋণ সালিশী বোর্ড স্থাপন করা হয় এবং প্রজাস্বত্ত্ব আইন পাশ করে জমির উপর কৃষকের মালিকানা কায়েম করেন, ফলে বাঙ্গালী কৃষক সমাজ জমিদারী সামন্তবাদের শোষণ থেকে মুক্ত হয়।
বাংলার প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি বহু কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন। শিক্ষার পাশাপাশি কৃষি খাতকেই গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তার আমলেই হত দরিদ্র কৃষরের উপরে কর ধার্য না করে সারা বাংলায় প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন করা হয়। তাছাড়া বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ এর পদক্ষেপ তিনিই গ্রহণ করেছিলেন। এ পদক্ষেপের আলোকে বৃটিশ সরকার ক্লাউড কমিশন গঠন করেন। কমিশনের সুপারিশ প্রেক্ষিতে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ত আইন সংশোধনী পাশ হয় এবং জমিদারদের লাগামহীন নিষ্ঠুর নির্মম অত্যাচারের হাত থেকে বাংলার আপামর কৃষককুল মুক্তি পায়। শেরে বাংলার একান্ত প্রচেষ্টায় বঙ্গীয় চাকুরি নিয়োগবিধি প্রবর্তনসহ চাষী খাতক আইন এর সংশোধনী করা হয়। চাষী খাতক আইন সংশোধনের মাধ্যমে ঋণ সালিশী বোর্ডকে শক্তিশালী করা হয়। তাছাড়া ক্লাউড কমিশনের সুপারিশে হক সাহেব আইন পরিষদে মহাজনী আইন পাশ করান। মহাজনী আইন পাশ হওয়ায় কৃষকের কাছ থেকে উচ্চ সুদের হার নির্দিষ্ট হয়। চক্রবৃদ্ধি সুদ বন্ধ করে দেয়া হয়। তিনি দোকান কর্মচারী আইন প্রণয়ন করে তিনি দোকান শ্রমিকদের সপ্তাহে একদিন বন্ধ ও অন্যান্য সুবিধা প্রদানের নির্দেশণা জারি করেন। তৎকালীন সময়ে বাংলার কৃষি পণ্যেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল সোনালি আঁশ নামে খ্যাত পাট। বেনিয়া গোষ্ঠীর খপ্তরে পড়ে বাংলার মেহনতী কৃষকগণ পাটের ন্যায্য দাম পেত না। কৃষকরা যেন পাটের ন্যায্য দাম পায়, সেজন্য তিনি পাট অধ্যাদেশ জারি করেন।
কৃষকদের জন্য এ কে ফজলুল হক সরকারি ঋণের ব্যবস্থা করেন। তাছাড়াও তিনি কৃষকদের জন ঋণ ব্যবস্থার পাশাপাশি ত্রাণ ও টেস্ট রিলিফের ব্যবস্থা করেন। শস্যের গুণগত মান উন্নয়নে তিনি উন্নত বীজ সরবরাহ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি চাষীদের ন্যায্যমূল্য প্রদানের নিশ্চয়তা প্রদান করেন। তিনি কৃষিশিক্ষা, প্রদর্শণী খামার, প্রচার, বাজার ঋণ প্রদান, গবেষণা, বিকল্প কর্মসংস্থান, গ্রামে গ্রামে পল্লী মঙ্গল সমিতি, খাদ্য ভান্ডার, কুটির শিল্প এসব কর্মসূচি গ্রহণ করেন।
বাংলাকে কচুরিপানার অভিশাপ মুক্ত করার পিছনে তার অবদান অনস্বীকার্য। কচুরিপানার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে কচুরিপানা পচানোর ব্যবস্থা করেন। পচানো কচুরীপানা উৎকৃষ্ট মানের জৈব সার। এই জৈবসার জমিতে ব্যবহারে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করেন। তাছাড়া ভূমিহীন কৃষকদের দ্বারা কচুরিপানা জমিয়ে ভাসমান কৃষিজমি তৈরি করে চাষাবাদে উদ্বুদ্ধ করেন। এভাবেই কচুরিপানার অভিশাপ থেকে বরিশালবাসীকে তিনি মুক্ত করেছিলেন।
রাজনীতির ধারাবাহিক পটচিত্রে একসময় কৃষক প্রজার পার্টির নাম থেকে প্রজা শব্দটি বাদ দিয়ে শ্রমিক শব্দটির অনু প্রবেশ ঘটে। তাই পরবর্তীতে দলটির নাম হয় কৃষক শ্রমিক পার্টি। নতুন নামে গঠিত দলটির সভাপতির দায়িত্ব ছিল শেরে বাংলার। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে দলটির সক্রিয় অংশগ্রহন ছিল। যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচি ছিল। পরবর্তীতে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রী পরিষদ এই ২১ দফা বাস্তবায়নে ব্যাপক তৎপর হয়েছিল। যুক্তফ্রন্টের গৃহীত উল্লেখযোগ্য কর্মসূচির মধ্যে বাংলার কৃষক জনতার মধুর মুখের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা, ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস, ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃৃতিতে শহীদ মিনার নির্মাণ, বাংলা নবর্ষের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা, বর্ধমান হাউসকে বাংলা ভাষা গবেষণা কেন্দ্র বা বাংলা একাডেমি ঘোষণা এবং জমিদারি ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে উচ্ছেদের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এত সব আয়োজনের পিছনে শেরে বাংলার প্রত্যক্ষ ও সক্রিয় ভূমিকা ছিল।
বাংলার কৃষির আধুনিকায়নে শেরে বাংলার ভূমিকা অপরিসীম। তিনি ঢাকা, রাজশাহী এবং খুলনায় কৃষি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। তৎকালীন পাক-ভারত উপমহাদেশের প্রথম কৃষি শিক্ষা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান কৃষি ইনস্টিটিউট, ঢাকার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছেন তিনি নিজেই। প্রাণী সম্পদ বৃদ্ধির জন্য তিনি উন্নতজাতের গবাদি পশু আমদানী এবং পশুপালন উন্নয়নের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেন। গবাদি পশু পালন ও দুগ্ধ সরবরাহ বাড়ানোর জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করেন।
বাংলার কৃষিতে তার অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য কৃষি ইনস্টিটিউট,ঢাকাকে পরবর্তীতে শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নামকরণ করা হয়। তাছাড়া তার নামে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি করে ছাত্রাবাসের নামকরণ করা হয় ।
শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক এদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন। এ দেশের কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়সহ আর্থ সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রেখেছেন। অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দুরদর্শিতার জন্য আজ ও আগামী প্রজন্মের কাছে তিনি সম্মান ও শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে থাকবেন অনাদি অনন্তকাল।
সংকলিত সূত্র: উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া, ইন্টারনেট এসব।

 

- Advertisement -

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.