- Advertisement -

বাংলা নববর্ষ  ও কৃষকের উৎসব

বাংলা নববর্ষ  ও কৃষকের উৎসব

1,770

- Advertisement -

 

বাংলা নববর্ষ  ও কৃষকের উৎসব

কৃষিবিদ মোহাইমিনুর রশিদ

জীর্ণ পুরাতন বছরের দু:খ,ক্লেশ,যাতনাকে দূরে সরিয়ে জীবনের হিসাবে নতুন খাতা শুভ হালখাতা নিয়ে বছর ঘুরে আবারো এসেছে বাঙালির চির ঐতিহ্যের আর উৎসবময় সংস্কৃতির সর্বজনীন রূপের ধারক শুভ নববর্ষ। বৈশাখী নববর্ষ নবসৃষ্টির অগ্রদূত,সুন্দর স্বপ্ন বুননের অগ্রপথিক ও নতুনের বিজয়কেতন। আজ শুভ নববর্ষের শুভ মাহেন্দ্রক্ষণে শামিল আমরাও। তাই সবাইকে জানাচ্ছি শুভ নববর্ষ।
পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষের প্রথম মাসের প্রথম দিন। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বাহক পহেলা বৈশাখ বাঙালির সর্বজনীন, সর্ববৃহৎ এবং অসাম্প্রদায়িক উৎসবের দিন। অতীতের ভুল ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় আনন্দঘন পরিবেশে উদযাপিত হয় নববর্ষের প্রথম দিন। দিনটি জাতীয়ভাবেও পালিত হয়।  শুভ নববর্ষ একটি ট্রাডিশন-একটি ঐতিহ্য। স্বাতন্ত্র্যবোধ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ভাষায় আবহমানতা বৈশাখী নববর্ষের ভিন্নতর বৈশিষ্ট্য। বাঙালির লোক জীবনের সাংস্কৃতিক ধারাকে জোরদারের একটি নতুন আবহ সৃষ্টিতে প্রতিবছরই ফিরে আসে বৈশাখী শুভ নববর্ষ।

বাংলা সনের কথা ও পহেলা বৈশাখের কথা:
সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি দিল্লির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন ১৪ এপ্রিল, ১৫৫৬ বা ২ রবিউস সানি ৯৬৩ হিজরিতে আর এভাবেই সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের সময় থেকে বাংলা নববর্ষের যাত্রা শুরু হয়। বলা হয়ে থাকে ফসল কাটার মৌসুমে খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য এ সন চালু করা হয়েছিল। তাই বাংলা সনের প্রবর্তনে কৃষি, কৃষকরাই মূল ক্রীড়নকের দাবিদার। তবে অনেক গবেষণার পর পহেলা বৈশাখ হিসেবে ১ বৈশাখ, ১৪০২ থেকে অর্থ্যাৎ ১৪ এপ্রিল, ১৯৯৫ থেকে এটি কার্যকরের সিদ্ধান্ত নেয়। এভাবেই পহেলা বৈশাখরূপে প্রতিবছরই হাজির হয় ১৪ এপ্রিল অর্থ্যাৎ শুভ নববর্ষ।

কৃষকের উৎসব
নববর্ষ কেন্দ্রিক বাংলার কৃষকদের মাঝেও নানামুখী উৎসবের কার্যক্রম লক্ষ্য করা যায় যেমন-

হালখাতা: নতুন বাংলা বছরের হিসাব পাকাপাকিভাবে টুকে রাখার জন্য ব্যবসায়ীদের নতুন খাতা খোলার আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ হালখাতা। এতে তাদের কাজ কারবারের লেনদেন, বাকি-বকেয়া, উসুল আদায় সবকিছুর হিসাব-নিকাশ লিখে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। গ্রাম বাংলার প্রতি বাজারে বাজারে এই রীতি লক্ষ্য করা যায়, যার মূল ক্রেতা হলেন গ্রামীন কৃষক।

পূন্যাহ: সাধারণত জমিদারি আমলেই অনুষ্ঠিত হতো পূণ্যাহ অনুষ্ঠান। এটি ছিল খাজনা আদায়ের একটি আনুষ্ঠানিক প্রীতিপূর্ণ অনুষ্ঠান। মূলত এটি ছিল কৃষিভিত্তিক অনুষ্ঠান। এখনও এই অনুষ্ঠান চলমান।

গম্ভীরা: প্রচলিত সামাজিক সমস্যা নিয়ে তৈরি লোকগীতি ও লোকনৃত্যের আঞ্চলিক অনুষ্ঠান গম্ভীরা। এটি ভারতের মালদহ এবং বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চলের আঞ্চলিক অনুষ্ঠান।

বলী খেলা: বলী খেলা কেবল চট্রগ্রামেই সীমাবদ্ধ। পুরো বৈশাখব্যাপী এ খেলার আয়োজন করা হয়। এ খেলায় কুস্তিগীররা তাদের শারীরিক শক্তির পরিচয় দিয়ে থাকে। বিজয়ী কুস্তিগীরকে নগদ অর্থ ও কাপড় পুরস্কার দেয়া হয়।

আমানি: বাংলা নববর্ষের খুবই প্রচলিত অনুষ্ঠান। চৈত্র মাসের শেষ দিন সন্ধ্যায় গৃহিণীরা এক হাড়ি পানিতে অল্প পরিমাণ চাল ভিজিয়ে তার মধ্যে একটি কচি আমের ডাল বসিয়ে রাখেন। পহেলা বৈশাখে সূর্যোদয়ের আগে বাড়ির সবাই এ ভিজা চাল খেয়ে থাকে। আর হাড়িতে ডুবানো আমের শাখা দিয়ে গৃহিণীরা সকলের গায়ে পানি ছিটিয়ে দেন।

ষাড়ের লড়াই: আবহমান গ্রাম বাংলার চির চিরায়ত কৃষকদের প্রধান আকর্ষণ ষাড়ের লড়াই। প্রতি বছরেই বৈশাখ মাসের প্রথম দিকে ষাড়েই লড়াই অনুষ্ঠিত হয়।

বৈশাখী মেলা: সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক ও সর্বজনীন উৎসব বৈশাখী মেলা। এ মেলা সাধারণত একদিন থেকে তিনদিন অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাতদিনও স্থায়ী হয়। এ দেশে জমিদারি আমলে খাজনা আদায়ের লক্ষ্যেই সম্ভবত বৈশাখী মেলার পত্তন ঘটে। বস্তুত বৈশাখী মেলা বাঙালির সার্বজনীন উৎসবের এক ভগ্নাংশ মাত্র। এটি বর্তমানে একটি সাংস্কৃতিক লোক-উৎসবে পরিণত হয়েছে সারাদেশে। এটি কোন ধর্মীয় ঐতিহ্য, কিংবদন্তী কিংবা বিভিন্ন পালা পার্বন নির্ভর অনুষ্ঠান নয়। সে কারণেই এটি সমস্ত বাংলা ও বাঙালির সার্বজনীন উৎসব। বাঙালির লোকায়ত সংস্কৃতির বিভিন্ন পলিমাটির সমন্বয়েই এটি গড়ে উঠেছে। বৈশাখী মেলা শহরের চেয়ে গ্রাম গঞ্জেই অধিক বসে। তাই বৈশাখী মেলা যেন গ্রাম জীবনের জাগরনের প্রতীক হয়ে ওঠে। আশা আকাঙ্খা ও আনন্দের প্রতীক বৈশাখী মেলা ছন্দহীন জীবনে আনে আনন্দের জোয়ার। শিশু কিশোরদের জীবনে আনে অনির্বচনীয় সুখ ও উল্লাস। বস্তুত গ্রাম বাংলার লোকজীবনের সঙ্গে বৈশাখী মেলার আবেদন অত্যন্ত নিবিড় ও গভীর।

লাঠিখেলা:  বাংলা নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে বিভিন্ন অঞ্চলে লাঠিখেলার আয়োজন করতে দেখা যায়। একেক এলাকায় লাঠিখেলার একেক নাম। লাঠিখেলার জন্য কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহের পাশাপাশি সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা প্রভৃতি জেলার অত্যন্ত সুখ্যাতি রয়েছে। মানিকগঞ্জ অঞ্চলে লাঠিখেলাকে সরদার বাড়ি বলা হয়ে থাকে। প্রতি বাংলা বছরের শ

গ্রামীন অঞ্চলের সীমানা পেরিয়ে শহরাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ছে বাংলা নববর্ষ উৎসব।

মঙ্গল শোভাযাত্রা: বাঙালির বর্ষবরণের আনন্দ আয়োজনে মিশে আছে মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে প্রতিবছরই পহেলা বৈশাখে এ মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। এ শোভাযাত্রায় চারুকলার শিক্ষক শিক্ষার্থী ছাড়াও বিভিন্ন স্তরের বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশগ্রহন করে। এ শোভাযাত্রায় বিভিন্ন ধরনের প্রতীকী শিল্পকর্ম বহন করা হয়। আরও থাকে বাংলা সংস্কৃতির পরিচয়বাহী নানা প্রতীকী উপকরণ, রং বেরংয়ের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিলিপি। ১৯৮৯ সালে প্রথম শোভাযাত্রায় ছিল পাপেট, ঘোড়া ও হাতি। ১৯৯০ এর আনন্দ শোভাযাত্রায় নানা ধরনের শিল্পকর্মের প্রতিকৃতি স্থান পায়।

বৈসাবি: এ উৎসব প্রতি বছর ইংরেজি এপ্রিল মাসের ১২, ১৩ ও ১৪ তারিখ এবং বাংলা চৈত্র মাসের ৩০ ও ৩১ তারিখ এবং নতুন বছরের বৈশাখের ১ তারিখ পালন করা হয়। বাংলা বছরের শেষ দুই দিন ও নতুন বছরের প্রথম দিন দেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসমূহ, বিঝু, সাংগ্রাই, বৈসু, বিষু, বিহু প্রভৃতি নামে এ উৎসব পালন করলেও সমতলে এটি বৈসাবি নামে পরিচিত। চাকমারা এ উৎসবকে বিঝ, ত্রিপুরারা বৈসু, মারমারা সাংগ্রাই, এবং তঞ্চৈঙ্গারা বিসু নামে আখ্যায়িত করে।

হাজার বছরের লালিত সুস্থ- সুন্দর বাঙালি সংস্কৃতির প্রতীক পহেলা বৈশাখের প্রেরণায় অতীতের সব যাতনা, ক্লেশ উবে গিয়ে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, রাজনৈতিকসহ জাতীয় পর্যায়ের সব স্তরে নেমে আসুক অনাবিল সুখ-শান্তি, চির অবসান ঘটুক অবাঞ্চিত হিংসা-বিদ্বেষের- এ প্রত্যাশায় বুক বাধি। সবাইকে আবারো শুভ নববর্ষ।

 

- Advertisement -

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.