- Advertisement -
কার্তিক মাসের কৃষি
কৃষিবিদ মোহাইমিনুর রশিদ
হেমন্ত কালের শুরু কার্তিক মাস দিয়ে। মাঠে সোনালী ধানের ক্ষেত এবং নতুন ধানের ঘ্রাণের মৌ মৌ গন্ধে মাতুয়ারা প্রকৃতি। কার্তিক মাসে আমন ধান কাটার প্রস্তুতি চলে গ্রাম বংলার ঘরে ঘরে। একই সাথে রবি ফসলের চাষাবাদে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন গ্রামের কৃষক। এ মাসে মাঠ পর্যায়ের মূল কাজগুলো হলো তৈরি, বীজ বপন, চারা রোপণ, গাছের যত্ন, গৃহপালিত পশু-পাখি ও মাছের পরিচর্যায় কেটে যায় গ্রামের কৃষকগণের সকাল-সন্ধা।
আগামী মৌসুমের জন্য আমন ধানের বীজ সংগ্রহ করতে চাইলে সুস্থ্য সবল ভালো ফলন দেখে ফসল নির্বাচন করতে হবে। রোদেলা দিনে সংগ্রহ করে মাড়াই-ঝাড়াই করতে হবে। সংগ্রহ করার সময় আড়াই বাড়ি পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। তারপর ভালোভাবে ছায়া ও রোদে শুকাতে দিন। শুকানো গরম ধান আবার ঝেড়ে পরিস্কার করে এবং ছায়ায় রেখে ঠান্ডা করতে হবে। । বীজ রাখার পাত্রটি একটু উপরে রাখা ভালো। পোকার উপদ্রব থেকে রক্ষা পেতে ধানের সাথে নিম বা নিসিন্দার পাতা শুকিয়ে গুঁড়ো করে মিশিয়ে দিলে পোকা ধরা বন্ধ হবে। তাছাড়া সাধারণ ধান সংগ্রহে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। খড় গবাদিপশুর খাদ্য, তাই খড় ভালো করে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।
ভূট্টা একটি বহুমূখী ফসল। মানুষের খাবারের পাশাপাশি পশু খাদ্য, পোল্ট্রি খাদ্য, মাছের খাদ্য ও জ্বলানি হিসেবে ভুট্টা বেশ জনপ্রিয়। ভূট্টা চাষে ঝুঁকি কম, খরচ কম অথচ লাভ বেশি। পুষ্টিকর ফসল ভূট্টা চাষের এখনই উপযুক্ত সময়। বৃষ্টির পানি জমে না এমন উঁচু বা মাঝারি উঁচু জমি ভূট্টা চাষের জন্য উপযোগী। জমির মাটি বেলে দো-আঁশ বা এঁটেল দো-আঁশ হলে ভালো হয়। ভূট্টা সারা বছরই চাষ করা যায়, তবে এ মৌসুমে অগ্রহায়ণ মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত বীজ বপন করতে পারলে ভালো ফলন পাওয়া যাবে। আমাদে দেশে চাষের উপযোগী বেশ কয়েটি জাত আছে, যেমন- খই ভূট্টা, বর্ণালী, শুভ্রা, মোহর, বারি ভূট্টা-৫, বারি ভূট্টা-৬, বারি হাইব্রিড ভূট্টা-১, প্যাসিফিক-১১, প্যাসিফিক-৬০, প্যাসিফিক-৭১০, এসব জাত উল্লেখ করার মত। বোনার আগে বীজ শোধন করে নেয়া ভালো। এক হেক্টর জমিতে বপনের জন্য ২৫-৩০ কেজি ভূট্টা প্রয়োজন। তবে খই ভূট্টা বা হাইব্রিড ভূট্টার বেলায় এর অর্ধেক অর্থাৎ ১২-১৫ কেজি হলেই চলে। ভূট্টা বীজ বপনের পর নিয়মিত প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করতে হবে।
গম বীজ বপন করতে চান তবে কার্তিকের দ্বিতীয় পক্ষ থেকে গম বীজ বপনের প্রস্তুতি নিতে হবে। দো-আঁশ মাটেতে গম চাষ করা হলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। বেশি ফলন পাওয়ার জন্য আধুনিক জাত ব্যবহার করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) কর্তৃক উদ্ভাবিত গমের আধুনিক জাতগুলোর মধ্যে জনপ্রিয় কয়েকটি জাত হচ্ছে- প্রতিভা, অগ্রাণী, সৌরভ, গৌরব, আকবর, আনন্দ, বরকত, কাঞ্চন, পাশাপাশি বারি গম২৫, বারি গম ২৭, বারি গম৩০, বারি গম৩৩ এসব । বীজ বপনের আগে শোধন করে নেয়া দরকার। অনুমোদিত ছত্রাকনাশক ব্যবহার করে বীজ শোধন করে নিতে হবে। সেচ দিয়ে বা সেচ ছাড়া দু’ভাবে গম চাষ করা যায়। সেচযুক্ত চাষের ক্ষেত্রে এক হেক্টর জমিতে প্রায় ১৩৫ কেজি অর্থাৎ বিঘা প্রতি প্রায় ১৬ কেজি এবং সেচ ছাড়া চাষের জন্য সাড়ে ১৩ কেজি বীজের প্রয়োজন। গম বীজ সারি করে বপন করা ভাল। আপনার গমের জমিতে প্রয়োজনীয় ইউরিয়া সার ৩ কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ করতে হবে। বীজ বপনের ১৭-২১ দিনের মধ্যে প্রথম সেচ দেয়া প্রয়োজন। এরপর প্রতি ৩০-৩৫ দিন পর ২ বার সেচ দিলে খুব ভালো ফলন পাওয়া যায়।
কার্তিক মাসের প্রথম থেকেই আলুর জমি তৈরি, সার প্রয়োগ এবং বীজ বপন শুরূ করতে হবে। বেলে দো-আঁশ মাটি আলু চাষের জন্য বেশি উপযোগী। ফলন বেশি পাওয়ার জন্য ভালো বীজ আলু ব্যবহার করতে হবে। ভালো জাতগুলো হলো- হীরা, ক্লিওপেট্রা, প্যাট্রোনিজ, গ্রানোলা, বিনেলা, ডায়মন্ড, কার্ডিনাল, বারি আলু ১৩, ১৯ ৭০, ৭৬, ৭৯ এসব। প্রতি বিঘা জমিতে ২০০-২৬৬ কেজি আলু বীজের প্রয়োজন হয়। বীজ আলু বড় হলে কেটে টুকরা করে নিতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে প্রতিটি টুকরায় যেন ৩-৪ টি চোখ বা কুঁড়ি থাকে। বীজ বপনের জন্য সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ৫০-৬০ সে.মি. এবং সারিতে বীজের দূরত্ব হবে ২০-২৫ সে.মি.। ৫-৭ সে.মি. গভীরে বীজ বপন করতে হবে।
কার্তিক মাস সরিষা চাষেরও উপযুক্ত সময়। সরিষার প্রচলিত জাত গুলির মধ্যে টরি-৭, রাই-৫, বারি সরিষা-৬, বারি সরিষা-৭, বারি সরিষা-৮, বারি সরিষা ১১, বারি সরিষা ১৪, বারি সরিষা ১৫, বিনা সরিষা ৯ এসব জাতগুলি উল্লেখযোগ্য। প্রতি বিঘা জমিতে ১-১.৫ কেজি সরিষা বীজের প্রয়োজন হয়। তবে জাত ভেদে কিছুটা তারতম্য হয়ে থাকে।
ডাল হলো গরিবের আমিষ। আমিষের ঘাটতি পূরণ করতে হলে ডাল ফসল চাষে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। মসুর, মুগ, মাসকলাই, মটর আড়হর, সয়াবিন, খেসারি, ছোলাসহ অন্যান্য ডাল জাতীয় ফসল এ সময় চাষ করতে পারনে। এজন্য উপযুক্ত জাত নির্বাচন, সময়মতো বীজ বপন, সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ পরিচর্যা সেচ, বালাই ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন করতে হবে। এমাসে পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, ধনিয়া চাষ করা যায়। সব ফসলের বেলায় আধুনিক প্রযুক্তি অনুসরণ করা উচিত। মনে রাখতে হবে এ মৌসুমে পানির অভাব হয়। তাই বেশি ফলন পেতে হলে জমিতে পানি সেচ দিতে হবে।
বোরো ধান উৎপাদনে, শুরুতেই আপনার কাঙ্খিত জাতের গুণগতমানের বীজ সংগ্রহ করে নিন। আগাম জাতের মধ্যে ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান৬৭, ব্রি ধান৭৪, ব্রি ধান৮১, ব্রি ধান৮৪ এবং ব্রি ধান৮৮ এর বীজ সংগ্রহ করতে পারেন। দীর্ঘ মেয়াদী জাতের মধ্যে ব্রি ধান২৯, ব্রি ধান৫৮, ব্রি ধান৬৯, ব্রি ধান৮৯ এর বীজ সংগ্রহ করতে পারেন। চিটা ও শৈত্য প্রবাহের তীব্রতা থেকে রেহাই পেতে দীর্ঘমেয়াদি জাতসমূহের বীজতলা ০১ নভেম্বর থেকে ০৭ নভেম্বর এবং স্বল্পমেয়াদি জাতগুলো ১৫ নভেম্বর হতে ২১ নভেম্বরের মধ্যে বীজতলা তৈরি করতে হবে। বোরো ধানের চারার বয়স ৩৫-৪৫ দিনের মধ্যেই রোপণ করতে হবে।
এ সময় পুকুরের আগাছা পরিস্কার, সম্পূরক খাবার প্রয়োগ ও সার প্রয়োগ করতে হবে। তাছাড়া জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাও এ সময় জরুরি। রোগ প্রতিরোধের জন্য একর প্রতি ৪৫-৬০ কেজি চুন প্রয়োগ করা যেতে পারে। মাছ চাষ সংক্রান্ত যে কোন পরামর্শের জন্য আপনি আপনার নিকটতম উপজেলা মৎস্য অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন।
বর্ষায় হয়তো আপনার গবাদিপশুর আবাসস্থল নষ্ট হয়েছে। তাই এদের আবাসস্থল মেরামত করে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখুন। গবাদিপশুকে খড়ের সাথে তাজা ঘাস খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো। সেজন্য ভূট্টা, মাসকলাই, খেসারি রাস্তার ধারে কিংবা পতিত জমিতে বপন করে গবাদিপশুকে খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন। এতে গবাদিপশুর স্বাস্থ্য ও দুধ দুটোই বাড়ে। এ সময় রাতের বেলা গবাদিপশুকে খোলা আকাশের নীচে রাখবেন না। কারণ কুয়াশায় গবাদিপশুর ঠান্ডা লেগেযেতে পারে। গর্ভবতী গাভী এবং বাছুরের যত্ন নিতে হবে। কার্তিক মাসে গবাদিপশকে কৃমির ওষুধ খাওয়ানো দরকার। তাছাড়া গবাদিপশুর তড়কা, গলাফোলা, মুরগির রাণীক্ষেত, হাঁস-মুরগির কলেরাসহ অন্যান্য রোগের প্রতিষেধক টিকা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য আপনার নিকটতম একজন পশু চিকিৎসকের পরামর্শ ও সহযোগিতা নিতে পারেন।
- Advertisement -
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.