- Advertisement -
সুনিপূণ ইঞ্জিনিয়ারিং: এলএলপি (লাইন,লোগো,পার্চিং)
কৃষিবিদ মোহাইমিন
নির্ভুল নিশানায় চলছে কাজ। কোন থামাথামি নাই। যে যত তাড়াতাড়ি পিছনে যাবেন তিনিই হবেন প্রথম। সবাই একমনে গভীরভাবে কাজে আত্ননিমগ্ন। জমিটাকে যদি নকশীকাঁথা ধরি, এলএলপি নিশ্চয়ই সুইসুতার সুনিপূণ প্রকৌশল। প্রতিটা গোছা থেকে আরেকটা গোছার দুরত্ব একই, সারি থেকে সারির দুরত্বও সমানতালে এগুচ্ছে। এ যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা, যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা। কত শত প্রকৌশলী, স্থপতি অনবদ্য সাধনায়ও এমন অপরুপ দৃশ্য তৈরি করতে পারবেন? তাইতো তারাই সবচেয়ে বড় সাধক। বলছিলাম বাংলার দামাল কৃষকদের কথা। নিরবিচ্ছিন্নভাবে লাইন লোগো বজায় রেখে ধানের চারা রোপণ করে যাচ্ছেন আপন মনে। লাইন, লোগো ও পার্চিংকৃত রাস্তার পাশের রোপণকৃত আমন ধানের ক্ষেতগুলো অনেকটাই নকশীকাঁথার আল্পনাকেও হার মানাবে। খুব মিস করছি তোমায় প্রিয় জসীম উদ্দিন। তোমার লেখনিতে হয়ত কৃষকের শৈল্পিক এলএলপি কাহিণীটাও ইতিহাসের পাতায় জায়গা পেতো।
রোপা আমন ধানের চারা রোপণের ধুম পড়েছে সারা বাংলায়। নির্বিঘ্নে ফসল উৎপাদন তথা ফলন বৃদ্ধির জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক কতকগুলো নির্দেশণা দিয়েছে। নির্দেশণাগুলো কৃষকদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে পথ ঘাট মাঠে ব্যতিব্যস্ত কৃষি কর্মীরাও। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক আমন ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য একটি কালজয়ী পদক্ষেপ ও দারুণ নির্দেশণা হলো এলএলপি। অর্থ্যাৎ এল মানে লাইন বা সারি, এল মানে লোগো ও পি মানে পার্চিং। তিনটা আলাদা আলাদা প্রযুক্তি, যা কৃষকেরা মাঠে বাস্তবায়ন করলে ফলন বৃদ্ধি পাবে নিশ্চিত।
প্রথমেই আসি লাইন বা সারিতে রোপণ নিয়ে, রোপা আমন ধানের চারা লাইনে রোপণ খুবই উপযোগী পদ্ধতি। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এর বিজ্ঞানীগণের তথ্য মতে সারি থেকে সারির দুরত্ব হবে ২০-২৫ সেমি বা ৮-১০ ইঞ্চি গড়ে ৯ ইঞ্চি এবং সারিতে গাছের গুছি থেকে গুছির দুরত্ব হবে ১৫-২০ সেমি বা ৬-৮ ইঞ্চি বা গড়ে ৭ ইঞ্চি। লাইন বা সারিতে চারা রোপণ লাভজনক কারণ নির্দিষ্ট পরিমাণ জমিতে সংখ্যক গুছি থাকলে নির্দিষ্ট পরিমাণ ফলন পাওয়া যাবে। সারিবদ্ধভাবে চারা রোপণ করলে নিড়ানি যন্ত্র ব্যবহার করা সহজ হয় এবং তাতে খরচ কমে। গুটি ইউরিয়া সার ব্যবহার করা সহজ হয় । উপরন্তু প্রত্যেক গাছ সমান আলো, বাতাস ও সার গ্রহণের সুবিধা পায়; যা ভাল ফলনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
এবার আসি লোগো পদ্ধতি নিয়ে, লোগো ধান চাষের নব্য প্রযুক্তি হিসেবে খ্যাত। সাধারণত প্রতি ১০ সারির পরে (৮ টিও হতে পারে) একটি সারি বাদ দেয়া বা ফাঁকা রাখাই লোগো পদ্ধতি। এক্ষেত্রে ১২-১৬ ইঞ্চি পরিমাণ ফাঁকা রাখা উত্তম। পর্যাপ্ত আলো, বাতাস পাওয়ার সাথে সাথে আগাছা পরিষ্কার, সার প্রয়োগ এবং বালাইনাশক প্রয়োগসহ অন্যান্য আন্ত:পরিচর্যা করা খুবই সহজ হয়। লোগো পদ্ধতির আরেকটি বড় গুণ হলো লোগোযুক্ত জমিতে ইঁদুরের আক্রমন কম হয়। ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। লোগো পদ্ধতির ফলে লাইন কমে যায় ঠিকই তবে তাতে ফলন কমে না বৈকি ঢের বেশি হয়।
অপরটি হলো বহুল পরিচিত পদ্ধতি পার্চিং বা খুঁটি দেয়া। রোপণকৃত ধানের জমিতে বাঁশের কঞ্চি, গাছের ডাল, খুঁটি পুতে দিয়ে পাখিকে বসার জায়গা তৈরি করে দেয়া। এসব খুঁটিতে পাখি আরমে বসে ক্ষতিকর পোকার মথ, কীড়া এমনকি ডিমের গাদা খেয়ে পোকার গুষ্টি নষ্ট করে দিতে পারে। ইদানিং ধৈঞ্চা গাছও লাইভ পার্চিং হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ধান ক্ষেতের মাঝে বিঘা প্রতি ৫ থেকে ৭ টা পার্চিং পুতে দেয়া যায়। পার্চিং একটি পরিবেশবান্ধব কৃষি প্রযুক্তি। যা কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে দেয়। জীব বৈচিত্রকে রক্ষা করে ফলে উৎপাদন খরচ কমিয়ে দেয়।
লাইন, লোগো ও পার্চিং এর সংক্ষিপ্ত নামই হলো এলএলপি। এলএলপি প্রযুক্তিগুলো মাঠে যথাযথ বাস্তবায়নের ফলে প্রতি বিঘায় প্রায় ৫ মণ ফলন বৃদ্ধি করা যায়। বিষয়টি যদি একটু সহজ করে বলি, আমন ধানের সবচেয়ে জনপ্রিয় জাত ব্রি ধান৪৯। ধরি, ব্রি ধান৪৯ জাতের ধান গাছের প্রতি হিল বা গুছিতে সক্রিয় কুশি হয় ১৫ টি। প্রতিটি কুশিতে একটি করে ধানের ছড়া হয়। প্রতি ছড়ায় প্রায় ১৮০-২২০ টি ধান হয়ে থাকে।
লাইন লোগো বাস্তবায়নের ফলে প্রতি বিঘায় প্রায় ৩০,০০০ গুছি হয়। নিরবিচ্ছিন্ন পরিচর্যা, ইঁদুরের আক্রমন কম এবং পর্যাপ্ত আলো বাতাস ও সার গ্রহণের ফলে প্রতিটা সক্রিয় কুশিতে প্রায় ১০-১৫ টি পুষ্ট ধান বেশি হয়।
তাহলে হিসেব মোতাবেক, মোটা গোছা × মোট সক্রিয় কুশি × ১২ টি পুষ্ঠ ধান অর্থ্যাৎ ৩০,০০০×১৫×১২ মোট ৫,৪০০,০০০ টি বাড়তি পুষ্ট ধান পাওয়া যায়। আমরা জানি প্রতি ১০০০ ধানের ওজন ২৫ গ্রাম। তাহলে ৫৪ লাখ ধানের ওজন প্রায় ১৩৫ কেজি অর্থ্যাৎ ৩.৬ মণ। বাংলাদেশে প্রায় ৫৫-৫৬ লক্ষ হেক্টর জমিতে আমন ধান আবাদ হয়ে থাকে। যদি প্রতিটা জমিতে এই প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার নিশ্চিত হয় তাহলে কত লাখ মেট্রিক টন ধান বেশি উৎপাদন হবে প্রশ্নটা রেখেই দিলাম?
কথা কিন্তু একটাই, কৃষকরা ভালো থাকলে দেশ ভালো থাকবে। কৃষিই কৃষ্টি, কৃষিই সমৃদ্ধি।
ছবি ক্রেডিট: মিশুক,ইন্টারনেট ও উপজেলা কৃষি অফিস,পীরগঞ্জ, রংপুর ।
- Advertisement -
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.