- Advertisement -
কৃষিতে নতুন প্রযুক্তি: একোয়াপনিক্স
কৃষিবিদ মোহাইমিনুর রশিদ
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বিস্ফোরণ একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ। এ ভয়াবহ সমস্যার কারণে আমাদের দেশে প্রতিবছর প্রায় ৬৯ হাজার হেক্টর আবাদী জমি হারিয়ে যাচ্ছে। আবাদী জমি কমে যাওয়ার কারণে অল্প জায়গায় বেশি পরিমাণ খাদ্য উৎপাদনের দিকে নজর দিতে হচ্ছে। তাছাড়া কৃষিতে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যাদি ব্যবহারের ফলে খাদ্যমান সংকটের মুখে পড়েছে। এসব বিষাক্ত কৃষিজ পণ্য খাবার হিসেবে গ্রহণ করার ফলে মানুষ নানাবিধ শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। তাই খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জন এখন সময়ের দাবি। এজন্য কৃষি গবেষণায় নতুন নতুন আধুনিক প্রযুক্তি আবিষ্কার এবং সম্প্রসারণবিদরা তা মাঠ পর্যায়ে কৃষকের কাছে পৌছে দিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে কৃষির আধুনিক প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে অফুরন্ত সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে একটি নতুন কৃষি পদ্ধতি। আর তা হলো- একোয়াপনিক্স পদ্ধতি।
একোয়াপনিক্স হচ্ছে মাছ চাষ করে মাছের বিষ্ঠা সার হিসেবে পানিতে ব্যবহার করে তা দিয়ে মাটি ছাড়াই শাক-সবজি উৎপাদন ব্যবস্থা। এটা বাড়ির ছাদে সহজেই স্থাপন করা যায়। তাছাড়া প্রক্রিয়াটি জৈব পদ্ধতি হওয়ায় মানব স্বাস্থ্যের খুবই উপকারী। এছাড়া এ পদ্ধতিতে কোনো কীটনাশক ও সারের প্রয়োজন না হওয়ায় অল্প খরচে অনেক লাভবান হতে পারবে কৃষকরা। অর্থ্যাৎ একোয়াপনিক্স পদ্ধতি হলো বাড়ির ছাদে মাটি ছাড়াই সমন্বিতভাবে মাছ ও শাক সবজি চাষাবাদ করা। ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্য বিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক ড. এম এ সালাম সম্প্রতি এ পদ্ধতিটি আবিষ্কার করেন।
একোয়াপনিক্স পদ্ধতির সুবিধাসমূহ: এ পদ্ধতিতে খুব অল্প জায়গা প্রয়োজন । বাড়ির ছাদেও সহজেই এটা স্থাপন করা যায়। উৎপাদিত ফসল বিষমুক্ত অর্থ্যাৎ জৈব পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদন করা হয়। এতে বালাইনাশক বা রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয় না। তবে এ পদ্ধতিটি বাস্তবায়নে যথেষ্ট দক্ষতা ও ধৈয্যের প্রয়োজন। এ পদ্ধতিতে মাছ (তেলাপিয়া) এবং স্ট্রবেরী, লেটুস, টমেটো, কচু. শিম, পেঁপে, শশা, পুদিনা, ঢেড়স, ওলকপি এসব শাকসবজি চাষাবাদ করা যায়।
একোয়াপনিক্স পদ্ধতি দুভাবে করা যায়, যথা উলম্ব একোয়াপনিক্স ও আনুভূমিক একোয়াপনিক্স। উলম্ব পদ্ধতি হলো একটি গাছের ওপরে আরেকটি গাছ জন্মানো। এ পদ্ধতিতে স্বল্প জায়গায় অনেক গাছ একসাথে লাগানো যায়। উলম্ব পদ্ধতির পাশাপাশি আনুভূমিকভাবে দোতলা-তিন তলা পদ্ধতিতে একটি মাচার ওপর কয়েক সারি ছিদ্রযুক্ত পাইপ স্থাপন করে প্রতিটি ছিদ্রের মাঝে একটি করে ছিদ্রযুক্ত প্লাস্টিকের গ্লাসে ইটের খোয়া দিয়ে তার মাঝে সবজির চারা রোপণ করেও অল্প স্থান হতে অধিক ফসল উৎপাদন করা যায়। উলম্ব/খাড়াখাড়ি একুয়োপনিক্স পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদন করতে হলে সুনির্দিষ্ট কতগুলো বিষয়ের উপর বিশেষ ধারণা ও কলাকৌশল সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখা আবশ্যক এজন্য প্রথমেই উলম্ব পদ্ধতিতে ৪ ইঞ্চি ব্যাস ও ৪.৫ ফুট লম্বা এক একটি প্লাস্টিকের পাইপের মাঝে ১৩ থেকে ১৫ টি ছিদ্র করে তা নারিকেলের ছোবড়া দিয়ে ভর্তি করে দিতে হবে যাতে পাইপটি বেশি ভারী না হয় এবং আর্দ্রতা ধরে রাখতে পারে। পাইপের প্রতিটি ছিদ্রের মাঝে একটি করে শাক-সবজির চারা লাগিয়ে দিতে হবে। পাইপের ছিদ্রগুলোতে চারাগুলো লাগানোর সময় চারাগুলির শিকড়কে এমন ভাবে পাইপের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়া হয় যাতে তা নারিকেলের ছোবড়ার মাঝে ভালোভাবে ছড়িয়ে থাকে। এরপর পাইপগুলিকে উলম্বভাবে একটি বাঁশের সাথে ঝুলিয়ে দিয়ে নীচের দিকে একটি প্লাস্টিকের মগযুক্ত করে তাতে একটি চিকন পাইপ লাগিয়ে একটি নির্গমন পাইপের সাথে সংযুক্ত করে দিতে হবে। ফলে পাইপের ওপর দিয়ে প্রবাহিত পানি পাইপের মাঝে অবস্থিত নারিকেলের ছোবড়া ও গাছের শিকড়ের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নির্গমন পাইপের সাহায্যে পুনরায় মাছের ট্যাঙ্কে এসে পড়ে।
এ পদ্ধতিতে পাইপের এক পাশ হতে মাছের পানি সরবরাহ করা হয় এবং অপর পাশ দিয়ে পানি মাছের ট্যাঙ্কে ফিরে আসে। এজন্য একটি ৫০০ লিটারের প্লাস্টিকের পানির ট্যাঙ্কের ওপরের মাথা কেটে পানি দিয়ে পূর্ণ করে দিতে হবে। তাতে প্রতি ১০ লিটার পানিতে একটি তেলাপিয়া মাছের পোনা ছেড়ে তাদের চাহিদা অনুযায়ী দুই বেলা বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত ভাসমান খাবার সরবরাহ করতে হবে। মাছের ট্যাঙ্কে যাতে অক্সিজেনের অভাব না হয় তার জন্য একটি বায়ু পাম্পের সাহায্যে পানিতে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করত হবে। এবার মাছের ট্যাঙ্কের পানিকে একটি ছোট্ট পাম্পের সাহায্যে প্রতিটি পাইপের ওপর দিয়ে তার মাঝে সরবরাহ করতে হবে। এই পদ্ধতিতে মাছের ট্যাঙ্কে এমোনিয়াযুক্ত দূষিত পানি নারিকেলের ছোবড়া ও গাছের শেকড়ের মাঝে বসবাসকারী ডি-নাইট্রিফায়িং ব্যাকটেরিয়া প্রথমে এমোনিয়াকে ভেঙ্গে নাইট্রাইট ও পরে নাইট্রোব্যাকটর নাইট্রেটে পরিণত করে যা পাইপে অবস্থিত গাছকে পুষ্টির জোগান দেয় এবং পরিষ্কার ও নিরাপদ পানি মাছের ট্যাঙ্কে ফিরে আসে। এখানে কোনো প্রকার মাটি, রাসায়নিক সার বা কীটনাশক ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না। মাটিতে যে স্থানে একটি মাত্র গাছের চারা লাগানো যায় সেই একই পরিমাণ স্থানে এ পদ্ধতিতে ১৩-১৫ টি চারা লাগানো সম্ভব।
অল্প জায়গায় বেশি পরিমাণ গাছ লাগানো যায়। তাছাড়া এ পদ্ধতিতে মাছ ও শাক সবজি উৎপাদনে ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ পানি কম লাগে।
ইতোমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এই পদ্ধতি অবলম্বন করে সাফল্য অর্জন করেছে। সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থাপনায় এ পদ্ধতি ব্যবহার করে আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা সহজ ও টেকসই হবে। এছাড়া জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও চাষযোগ্য জমির পরিমাণ দিন দিন হ্রাস পাওয়ায় এ পদ্ধতি আমাদের দেশের জন্য খুবই উপযোগী। তাছাড়া একটা পরিবারের জন্য অল্প জায়গা থেকে সারা বছর ব্যাপী শুধু মাত্র মাছের পানি ব্যবহার করে একই সঙ্গে মাছ ও প্রচুর শাক-সবজি উৎপাদন করা যায়।
- Advertisement -
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.