- Advertisement -

আষাঢ় মাসের কৃষি

মাসের কৃষি

997

- Advertisement -

 

আষাঢ় মাসের কৃষি

কৃষিবিদ মোহাইমিনুর রশিদ

ঋতু বৈচিত্র্যের বাংলাদেশে গ্রীষ্মের দাবদাহ অনলের পরেই আসে চিরযৌবনা ঋতুর রাণী বর্ষাকাল। বর্ষার আগমনে নীলাকাশ ছেয়ে যায় কালো মেঘে। জলদ গম্ভীর মেঘ গর্জনের সাথে থেকে থেকে বিদ্যুতের চমক। অবিশ্রান্ত বৃষ্টিধারা স্নিগ্ধতায় ভরে দেয় দিক-দিগন্ত। গ্রীষ্মদগ্ধ ধরণীর বুকে ভরে ওঠে সবুজ সমারোহ। মাঠ ঘাট, খাল বিল, নদী নালা, হাওর, বাওর পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে থৈ থৈ পানিতে। কদম আর তৃণঘাসে ফুটে ওঠে আনন্দের অশ্রুবিন্দু। সবার মতো কৃষকের মনেও দোলা দেয় এমন দিনে কী কী করা যায় এমন ঘন ঘোর বরষায়।

বর্ষার তন্ময়তা খানিকটা সরিয়ে চলুন জেনে নেই এই বর্ষাকালের প্রথম মাস আষাঢ় মাসে কৃষি ভূবনে কী কাজ করতে হবে। অত্যন্ত জরুরী কাজের মধ্যে প্রথমেই যে কাজটি করতে হবে তা হলো-রোপা আমনের বীজতলা তৈরিবৃষ্টি বা বন্যার পানিতে ডুববে না এমন উঁচু রৌদ্রময় জমি নির্বাচন করতে হবে বীজতলা তৈরির জন্য। বীজতলা তৈরির আগে জমির চারদিকের আইল ভালভাবে বেঁধে দিয়ে জমিতে পানি আটকিয়ে রাখতে হবে। এতে জমির মাটি নরম হবে, আবর্জনা ঘাস পঁচে জৈব পদার্থ মাটির সাথে মিশে মাটির উর্বরতা বাড়াবে। দু’চারদিন পর ৪/৫টা আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে জমিকে থকথকে কাদাময় করে নিতে হবে। প্রয়োজনীয় জৈব সার মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে ১ মিটার, প্রায় ৩ ফুট চওড়া এবং প্রয়োজনীয় লম্বায় প্লট আকারে ভাগ করতে হবে। দুই প্লট এবং বীজতলার চার দিকে ২৫ সে.মি অর্থাৎ ১০ ইঞ্চি চওড়া নালা রাখতে হবে। এই নালা দিয়ে প্রয়োজনীয় সেচ নিকাশ বা প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করা যাবে। কমপক্ষে ৮০% গজায় এমন সুস্থ, বালাইমুক্ত অঙ্কুরিত আমন বীজ প্রতি বর্গমিটার বীজতলার জন্য ৮০-১০০ গ্রাম হারে বীজ সুন্দরভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে। ভাল চারা পাওয়ার জন্য প্রতি বর্গমিটার জমিতে ২ কেজি গোবর, ১০ গ্রাম ইউরিয়া, ৫ গ্রাম পটাশ, ৫ গ্রাম টিএসপি এবং ৫ গ্রাম জিপসাম সার বীজ বপনের আগেই মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। বীজ বপনের আগে যদি বীজতলায় এক স্তর ছাই ছিটিয়ে দেয়া হয় তবে চারা তোলার সময় বেশ সুবিধা হবে। বীজ বপনের পর প্রথমে বীজতলা শুকানো, পরে প্রয়োজনীয় সেচ দেয়া, দীর্ঘ সময় পানি জমতে না দেয়া, আগাছা পরিস্কার, বালাই দমন, চারার বাড়বাড়তি কম হলে বা পাতার রঙ হলুদ হয়ে গেলে প্রতি লিটার পানির সাথে ১০ গ্রাম ইউরয়িা মিশিয়ে এক বর্গমিটার বীজতলায় ছিটিয়ে দেয়াসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ নিয়মিত করলে ভাল ফলাফল পাওয়া যাবে। ভাল ফলনের জন্য উচ্চ ফলন শীল বা হাইব্রিড জাতের ধান চাষ করতে পারেন। বীজ জাগ দেওয়ার আগে বীজ অবশ্যই বীজ শোধন করে নিবেন।

এক্ষেত্রে প্রথমেই জাত নির্বাচন করতে হবে। জাত নির্বাচনে মৌসুম, জমির অবস্থান, জমির উর্বরতা ও চাহিদা/বাজার দর বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হয়। আগাম জাতের মধ্যে রয়েছে ব্রি ধান৩২, ব্রি ধান৩৩, ব্রি ধান৩৯, ব্রি ধান৪৯ আবাদ করতে পারেন। এই জাতগুলোর বীজ আষাঢ় মাসে বপন করা উচিত। স্বল্পমেয়াদি ধানের জাত হিসেবে বিনা ধান ৭ এবং ব্রি ধান৬২ (জিংক সমৃদ্ধ) চাষ করতে পারেন। অধিক ফলনশীল মাঝারি থেকে মোটা চালের জন্য বিআর১০, বিআর১১, ব্রি ধান৩০, ব্রি ধান৩১ চাষ করা যায়। সুগন্ধি চালের জন্য ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান৩৭, ব্রি ধান৩৮ চাষ করা যায়। আগাম বন্যা  আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। তাই বন্যার পানি বা জলমগ্নতা সহনশীল জাত ব্রি ধান৫১, ব্রি ধান৫২, বিনা ধান১১, বিনা ধান১২ চাষ করা যায়। এই জাতগুলো আকস্মিক বন্যায় প্রায় ১০-১৫ দিন জলমগ্ন থাকার পরও ফলন ভালো হয়। নাবি জাত হিসেবে বিআর ২২, বিআর২৩, ব্রি ধান৪৬ অথবা স্থানীয় জাত যেমন শাইল জাতীয় ধানের জাত চাষ করা যায়। অল্প কথায় বলতে গেলে, আকস্মিক বন্যাপ্লাবিত এলাকার জন্য ব্রি ধান৫১, ব্রি ধান৫২; খরা প্রবন এলাকার জন্য ব্রি ধান৫৬, ব্রি ধান৫৭; স্বল্পমেয়াদি ব্রি ধান৬২, বিনা ধান ৭ এবং সাধারণ সকল জমির জন্য ব্রি ধান৪৯ এবং বিআর১১ খুবই উপযোগী। বীজতলা তৈরির পাশাপাশি মূল জমি নির্বাচন ও তৈরি প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।

আষাঢ় মাস মানেই বন্যার সম্ভাবনা। আগাম বন্যায় ডুবিয়ে দেয় পাকা আউশ ধান। সেজন্য আগাম আউশ ধান শতকরা ৮০ ভাগ পাকলেই কেটে মাড়াই-ঝাড়াই করে শুকিয়ে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। সোনালী আঁশ পাটগাছে ফুল ধরলেই বুঝতে হবে পাট কাটার সময় হয়েছে। ধারালো কাঁচি দিয়ে পাট কেটে চিকন মোটা এভাবে পাটের আঁটি আলাদাভাবে বেঁধে নিতে হবে। আঁটি বাঁধা অবস্থায় ৩-৪ দিন জড়ো করে রেখে দিলে পাতা ঝরে যাবে। এরপর মৃদু স্রোতযুক্ত পানিতে সোজা/আড়াআড়িভাবে পাট জাগ দিয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে প্রতি আঁটির ওজন যেন ১০ কেজির বেশি না হয়। এ সময় পাটের বিছাপোকা, ঘোড়া পোকা পাটের কচি পাতা, ডগা ও কুঁড়ি খেয়ে ফেতে পারে। চেলে পোকা ডগা ছিদ্র করতে পারে। এছাড়া ক্ষুদে মাকড়সা, পাতার হলদে রোগসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে। পাটকে রক্ষা করতে হলে পোকার ডিমের গাদা সংগ্রহ করে মেরে ফেলতে হবে, আগাছা পরিস্কার, আক্রান্ত গাছ তুলে ফেলা, পোকা খাদক পোকার জন্য জমিতে ডাল-পালা পুঁতা এবং সর্বশেষ ব্যবস্থা হিসেবে অনুমোদিত মাত্রায় উপযুক্ত বালাইনাশক সঠিক পদ্ধতিতে ব্যবহার করা হলে ভাল ফল পাওয়া যায়। পাট আঁেশর গুণাগুণ মূলত নির্ভর করে সঠিক ভাবে পাট পচনের ওপর। রিবন রেটিং বা পাটের ছালকরণ ও পচন পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।

আবহাওয়া এবং মৌসুম জনিত কারণে এ সময় শাকসবজি আবাদ ঝুঁকিপূর্ণ। তবুও আবহাওয়ার সাথে সমন্বয় করে আন্তরিকতা এবং সুষ্ঠু প্রচেষ্টার মাধ্যমে কিছু শাকসবজি যেমন- ডাঁটা, গিমাকলমি, পুঁইশাক, চিচিঙ্গা, ধুন্দুল, ঝিংগা, শশা, ঢেঁড়স, বেগুনসহ অন্যান্য শাকসবজি ভালভাবেই আবাদ করা যায়। এসব সবজির ভাল ফলন পেতে হলে গোড়ায় মাটি দেয়া, প্রয়োজনীয় সার ব্যবহার করা, পানি ব্যবস্থাপনা, আগাছা পরিস্কার, বাউনি বা মাচা ব্যবস্থাপনা, অতিরিক্ত বৃদ্ধি হলে ১৫-২০ % লতাপাতা কেটে ফেলা, সবজির হস্তপরাগায়ন এবং পোকা ও রোগ দমন যথাযথভাবে করতে হবে।

এসময় আগাম জাতের শিম এবং লাউয়ের জন্য উঁচু জমিতে ১ ফুট চওড়া এবং ১ ফুট গভীর মাদা তৈরি করে ১ মিটার প্রায় ৩ ফুট দূরত্বে একক বা জোড়া সারি করে জমিতে নকশা করে বীজ বপন করতে পারেন। ভাল ফলনের জন্য প্রতি গর্তে ১০ কেজি গোবর, ২০০ গ্রাম সরিষার খৈল, ২ কেজি ছাই, ১০০ গ্রাম টিএসপি ভালভাবে মাদার মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। প্রতি মাদায় ৩-৪ টি ভাল সবল বীজ রোপন করতে হবে। বর্ষার পানি যাতে শিমের মাদায় কোন ক্ষতি করতে না পারে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।

সারা বছরের মধ্যে এসময় বৃক্ষ জাতীয় গাছের চারা লাগাবার উপযুক্ত সময়। এসময় বৃক্ষ রোপন অভিযান চলছে সারাদেশে। যেখানেই উপযুক্ত জায়গা পাওয়া যাবে যেমন- বসতবাড়ির আঙ্গিনা, রাস্তাঘাট, পুকুরপাড়, বাঁধ, নদীর পাড়, ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আঙ্গিনা এবং পতিত অনাবাদি জমিতে পরিকল্পিতভাবে ফলজ, বনজ ঔষধি গাছের চারা রোপণ করা যায়। সরকারী বা বেসরকারী নার্সারী থেকে সুস্থ সবল চারা সংগ্রহ করতে হবে। চারা রোপণের আগে ১-২ ফুট চওড়া এবং ১-২ ফুট গভীর গর্ত করে পরিমাণমত পঁচা জৈব সার, ১০০ গ্রাম টিএসপি, ১০০ গ্রাম এমওপি সার মাটির সাথে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে। গর্ত ভরার ৭-১০ দিন পর গর্তের মাঝখানে পলিব্যাগ সরিয়ে মাটিসহ চারা বা কলম রোপণ করতে হবে। রোপণের পর শক্ত খুঁটির সাথে চারা বা কলম বেঁধে দিতে হবে। চারা রোপনের পর বেড়া বা ঘেরা দিয়ে চারা রক্ষা করা, গোড়ায় মাটি দেয়া, আগাছা পরি¯কার, সেচনিকাশ নিশ্চিত করতে হবে।

বৃষ্টি বা বন্যার কারণে এসময় পুকুরের পানি উপচিয়ে যেতে পারে সাথে মাছও চলে যাবে। তাই দেরি না করে ভালভাবে পুকুরের পাড় বেঁধে দিন। ভাল বিশ্বস্ত হ্যাচারি থেকে পোনা সংগ্রহ করে পুকুরে ছাড়ুন। আধুনিক উপায়ে মাছ চাষে সাধারণত প্রতিশতকে মাছের সংখ্যা ৩০-৩৫ টি, মাছের জাত এবং পরিমিত সুষম খাবারের নিশ্চয়তা করতে হবে। আপনি চাইলে অংশীদারি পুকুরে বা পর্যাপ্ত পানিসীমায় অনায়াসে স্বল্প খরচে খাঁচায় মাছ চাষ করতে পারেন। তবে যে কোন মাছ চাষে মৎস্যবিদ বা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিলে খরচ কম হবে লাভ বেশি হবে।

এসময় বৃষ্টি বা বন্যার কারণে গোচারণ ভূমি পানিতে তলিয়ে যায় এবং ঘাসের যেমন অভাব দেখা দেয় তেমনি এরা চলাফেরা করতে পারে না। এসময় আগে সংরক্ষণ করা শুকনা খড়, ভূসি, চালের কুড়া, অন্যান্য খড় বিছালি খাওয়াতে হবে। মাঠ-ঘাট থেকে সংগৃহীত সবুজ ঘাস ভালোভাবে পরিস্কার করে গবাদিপশুকে খাওয়াতে হবে। এ সময় গলাফোলা, বাদলা, তড়কা, ক্ষুরা রোগ মহামারি আকারে দেখা দিতে পারে। প্রতিষেধক টিকা দেয়া, প্রাণি চিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুসারে চিকিৎসা ও যত্ন নিতে হবে। এখন গবাদি পশুর কৃমির আক্রমণ বেশি হয়। সুতরাং কৃমির ওষুধ দ্রুত খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

 

- Advertisement -

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.