- Advertisement -
আশ্বিন মাসের কৃষি, ব্যস্ত দিবা নিশি
কৃষিবিদ মোহাইমিনুর রশিদ
বর্ষণ ভারাক্রান্ত দিনের অবসানের নীলাকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভাসিয়ে আর কাশফুলের শুভ্রতা নিয়ে আসে শরৎরানী। স্বচ্ছ রোদের শিশির ভেজা সকাল, ঘাসের শিখরে মুক্তবিন্দু, শিউলি ফোটা গন্ধ, শুভ্র কাশবন, শাপলা ফোটা সরোবর, আমন ধানের সবুজ সতেজ বিস্তার-শরতের এ অনুপম সৌন্দর্য তুলনাহীন। সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, আপনাদের সবার জন্য শুভকামনা। সাম্প্রতিক বন্যার সবটুকু ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া আর চলতি মৌসুমের পুরো পাওনা আদায় করতে কার্যকরী প্রস্তুতি নেয়ার সময় এখন। এ প্রেক্ষিতে আসুন সংক্ষেপে জেনে নেই আশ্বিন মাসের বৃহত্তর কৃষি ভুবনের করণীয় বিষয়গুলো।
আমন ধান
এখন আমন ধানের বাড়ন্ত পর্যায়। আপনি নিশ্চয় আপনার ধানের জমিতে পার্চিং বা ডাল পুতে দিয়েছেন। ধান গাছের বয়স ৪০-৫০ দিন হলে ইউরিয়ার শেষ কিস্তি প্রয়োগ করার এখনই সময়। সার প্রয়োগের আগে জমির আগাছা পরিষ্কার করে নিতে হবে এবং জমিতে ছিপছিপে পানি রাখতে হবে। এ সময় বৃষ্টির অভাবে খরা দেখা দিতে পারে। সেজন্য সম্পূরক সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। নিচু এলাকায় আশ্বিন মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত স্থানীয় উন্নত জাতের শাইল ধানের চারা রোপণ করতে পারেন। এক্ষেত্রে প্রতি গুছিতে ৫-৭টি চারা দিয়ে ঘন করে রোপণ করতে হবে। এ সময় বৃষ্টির অভাবে খরা দেখা দিতে পারে। এতে ফলন অনেক কমে যায়। সুতরাং খরা দেখা দিলে সম্পূরক সেচ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। নদী, পুকুর, খাল-বিল, ডোবা যেখানেই পানি পাওয়া যাবে সেখান থেকে পাম্প, নলকূপ, দোন, সেঁওতি দিয়ে সেচ দেয়া নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে সম্পূরক সেচ আমনের ফলন বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।
শিষ কাটা লেদাপোকা ধানের জমি আক্রমণ করতে পারে। প্রতি বর্গমিটার আমন জমিতে ২-৫টি লেদা পোকার উপস্থিতি মারাত্মক ক্ষতির পূর্বাভাস। তাই সতর্ক থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এ সময় মাজরা, পামরি, চুঙ্গি, গলমাছি পোকার আক্রমণ হতে পারে। এছাড়া খোলপড়া, পাতায় দাগপড়া রোগ দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে নিয়মিত জমি পরিদর্শন করে, জমিতে খুঁটি দিয়ে, আলোর ফাঁদ পেতে, হাতজাল দিয়ে পোকা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাছাড়া সঠিক বালাইনাশক সঠিক মাত্রায়, সঠিক নিয়মে, সঠিক সময় শেষ কৌশল হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।
আখ
সিলেট অঞ্চলে মাঠ পর্যায়ে আখের চাষাবাদ খুবই কম। কেউ কেউ যদি আখ চাষ করতে চান তাদের জন্য আখের চারা উৎপাদন করার উপযুক্ত সময় এখন। সাধারণত বীজতলা পদ্ধতি এবং পলিব্যগ পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করা যায়। তবে পলিব্যাগে চারা উৎপাদন করা হলে বীজ আখ কম লাগে এবং চারার মৃত্যুহার কম হয়। চারা তৈরি করে বাড়ির আঙিনায় সুবিধাজনক স্থানে সারি করে রেখে খড় বা শুকনো আখের পাতা দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। চারার বয়স ১-২ মাস হলে মূল জমিতে রোপণ করতে হবে। কাটুই বা অন্য পোকা যেন চারার ক্ষতি করতে না পারে সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে।
বিনা চাষে ফসল আবাদ
মাঠ থেকে বন্যার পানি নেমে গেলে উপযুক্ত ব্যবস্থাপনায় বিনা চাষে অনেক ফসল আবাদ করা যায়। এ সময় ভুট্টা, গম, আলু, সরিষা, মাসকালাই বা অন্যান্য ডাল ফসল বিনা চাষে লাভজনকভাবে অনায়াসে আবাদ করা যায়। সঠিক পরিমাণ বীজ, সামান্য পরিমাণ সার এবং প্রয়োজনীয় পরিচর্যা নিশ্চিত করতে পারলে লাভ হবে অনেক। জমির জো বুঝে এবং আবহাওয়ার কথা খেয়াল রেখে বিনা চাষে ফসল করলে খরচ খুব কম হয় এবং দ্রুত একটি ফসল পাওয়া যায়।
শাকসবজি
জমির মাটি এখনো ভেজা এবং স্যাঁতসেঁতে। আগাম শীতের সবজি উৎপাদনের জন্য উঁচু জয়গা কুপিয়ে পরিমাণ মতো জৈব ও রাসায়নিক সার বিশেষ করে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করে শাক উৎপাদন করা যায়। শাকের মধ্যে মুলা, লালশাক, পালংশাক, চিনাশাক, সরিষাশাক অনায়াসে করা যায়। তাছাড়া সবজির মধ্যে ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, টমেটো, বেগুন, ব্রোকলি বা সবুজ ফুলকপিসহ অন্যান্য শীতকালীন সবজির চারা তৈরি করে মূল জমিতে বিশেষ যত্নে আবাদ করা যায়।
শাকসবজি চাষাবাদ করতে হলে ভালোমানের বীজ ব্যবহার, বীজ শোধন, বীজতলার মাটি শোধন, মূল জমিতে ডলোচুন ব্যবহার এবং ডিএপি সারের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। তবেই ফলন ও উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে আপনি অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবেন।
কলা
আপনারা যারা কলা চাষ করেন তাদের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু কাজ। অন্যান্য সময়ের থেকে আশ্বিন মাসে কলার চারা রোপণ করা সবচেয়ে বেশি লাভজনক। এতে ১০-১১ মাসে কলার ছড়া কাটা যায়। ভালো উৎস বা বিশ্বস্ত চাষি ভাইয়ের কাছ থেকে কলার অসি চারা সংগ্রহ করে রোপণ করতে হবে। কলার চারা রোপণের জন্য ২-২.৫ মিটার দূরত্বে ৬০ সেমি. চওড়া এবং ৬০ সেমি. গভীর গর্ত করে রোপণ করতে হবে। গর্তপ্রতি ৫-৭ কেজি গোবর, ১২৫ গ্রাম করে ইউরিয়া, টিএসপি ও এওপি সার এবং ৫ গ্রাম বরিক এসিড ভালোভাবে মিশিয়ে ৫-৭ দিন পর অসি চারা রোপণ করতে হবে। কলাবাগানে সাথি ফসল হিসেবে ধান, গম, ভুট্টা ছাড়া যে কোন রবি ফসল চাষ করা যায়। এতে একটি অতিরিক্ত ফসলের এবং সে সাথে অর্থও পাওয়া যায়।
গাছপালা
উপজেলা, জেলা এমনকি বিভাগীয় পর্যায়ে ইতোমধ্যে বৃক্ষরোপন অভিযান ও ফলদ বৃক্ষমেলা শেষ হয়েছে। অনেকেই নতুনভাবে উদ্ধুদ্ধ হয়ে হয়ত বিভিন্ন জাতের গাছের চারা রোপন করেছেন। রোপণকৃত চারা কোনো কারণে মারা গেলে সেখানে নতুন চারা রোপণের উদ্যোগ নিতে হবে। রোপণ করা চারার যত্ন নিতে হবে এখন। যেমন বড় হয়ে যাওয়া চারার সঙ্গে বাঁধা খুঁটি সরিয়ে দিতে হবে এবং চারার চারদিকের বেড়া প্রয়োজনে সরিয়ে বড় করে দিতে হবে। মরা বা রোগাক্রান্ত ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে। চারা গাছসহ অন্যান্য গাছে সার প্রয়োগের উপযুক্ত সময় এখন। গাছের গোড়ার মাটি ভালো করে কুপিয়ে সার প্রয়োগ করতে হবে। দুপুর বেলা গাছের ছায়া যতটুকু স্থানে পড়ে ঠিক ততটুকু স্থান কোপাতে হবে। পরে কোপানো স্থানে জৈব ও রাসায়নিক সার ভালো করে মিশিয়ে দিতে হবে। গাছের জাত ও বয়সের কারণে সারের মাত্রাও বিভিন্ন হয়।
প্রাণিসম্পদ
হাঁস-মুরগির কলেরা, ককসিডিয়া, রানীক্ষেত রোগের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। প্রাথমিকভাবে টিকা প্রদান, প্রয়োজনীয় ওষুধ খাওয়ানোসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়ে প্রাণী চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া আবশ্যক। এ মাসে হাঁস-মুরগির বাচ্চা ফুটানোর ব্যবস্থা নিতে পারেন। বাচ্চা ফুটানোর জন্য অতিরিক্ত ডিম দেয়া যাবে না। তাছাড়া ডিম ফুটানো মুরগির জন্য অতিরিক্ত বিশেষ খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আশ্বিন মাসে গবাদিপশুকে কৃমির ওষুধ খাওয়ানো দরকার। গবাদিপশুকে খোলা জায়গায় না রেখে রাতে ঘরের ভেতরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। পানিতে জন্মানো পশুখাদ্য এককভাবে না খাইয়ে শুকিয়ে খরের সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে। এ সময় ভুট্টা, মাসকলাই, খেসারি, বুনো ঘাস উৎপাদন করে গবাদিপশুকে খাওয়াতে পারেন। গর্ভবতী গাভী, সদ্য ভূমিষ্ঠ বাছুর ও দুধালো গাভীর বিশেষ যত্ন নিতে হবে। এ সময় গবাদিপ্রাণির মড়ক দেখা দিকে পারে। তাই গবাদিপশুকে তড়কা, গলাফুলা, ওলান ফুলা রোগের জন্য প্রতিষেধক, প্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চত করতে হবে।
মৎস্যসম্পদ
বর্ষায় পুকুরে জন্মানো আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং পুকুরের পাড় ভালো করে বেঁধে দিতে হবে। পুকুরের মাছকে নিয়মিত পুষ্টিকর সম্পূরক খাবার সরবরাহ করতে হবে। এ সময় পুকুরের প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে। তাছাড়া পুকুরে জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং রোগ সারাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে । এ সময় সরকারি ও বেসরকারি মাছের খামার থেকে জিওল মাছের পোনা সংগ্রহ করে পুকুরে ছাড়ার ব্যবস্থা নিতে পারেন।
আশ্বিন মাসে সারা দেশজুড়ে ইঁদুর নিধন অভিযান শুরু হয়। আমন ধান রক্ষাসহ অন্যান্য ফসলের ক্ষতির মাত্রা কমানোর জন্য এ অভিযান চলে। এককভাবে বা কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় ইঁদুর দমন করলে কোনো লাভ হবে না। ইঁদুর দমন কাজটি করতে হবে দেশের সব মানুষকে একসাথে মিলে এবং ইঁদুর দমনের সব পদ্ধতি ব্যবহার করে। ইঁদুর নিধনের ক্ষেত্রে যেসব পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায় সেগুলো হলো- পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও আধুনিক চাষাবাদ, গর্তে ধোঁয়া দেয়া, ফাঁদ পাতা, উপকারী প্রাণী যেমন- পেঁচা, গুঁইসাপ, বিড়াল দ্বারা ইঁদুর দমন, বিষটোপ এবং গ্যাস বড়ি ব্যবহার করা। আসুন সবাই একসাথে অতিচালাক আমাদের এ পরম শক্র দমন করি। সবার জন্য নিশ্চিত সফল কৃষি উৎপাদন কামনা করে এ মাসের কৃষি এখানেই শেষ করলাম।
- Advertisement -
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.