- Advertisement -
আধুনিক উপায়ে গম উৎপাদন কৌশল
কৃষিবিদ মোহাইমিনুর রশিদ
বাংলাদেশে খাদ্য তালিকায় গম দ্বিতীয় প্রধান শস্য। খাদ্য মানের দিক থেকে গম চালের চেয়ে পুষ্টিকর। চালের তুলনায় গমে প্রোটিন, ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের পরিমাণ বেশি। খাদ্য তালিকায় পুষ্টিমান একটা গুরুত্ব বিষয়। শুধু ভাতের উপর নির্ভরশীল হলে পুষ্টির চাহিদা মেটানো কঠিন । তাই গম বা আটাকে আমাদের নিয়মিত খেতে হবে। তাছাড়া গম চাষে সেচ খরচ কম, সেচ ছাড়াও চাষ করা যায়, বিনা চাষে বা অল্প চাষেও আবাদ করা যায়। তাই যে সমস্ত জমিতে সেচ সুবিধা নাই সে সব জমিতে গম আবাদ করা যায় এবং চাষের অপেক্ষায় না থেকে বিনা চাষে অল্প সময়ের মধ্যে গম আবাদ করা যায়। প্রতি ১০ কেজি ধান থেকে প্রায় ৭ কেজি চাল পাওয়া যায়। কিন্তু ১০ কেজি গম থেকে প্রায় ১০ কেজি পরিমাণ আটা পাওয়া যায়। জাত ভেদে আমাদের দেশে গমের গড় ফলন হেক্টর প্রতি প্রায় ৩.৫ মে.টন হয়ে থাকে। সিলেট অঞ্চলে রবি মৌসুমে পানির খুব অভাব থাকে। তাই আধুনিক চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করে গম উৎপাদন করা খুবই সহজ।
গম চাষের জন্য পলিযুক্ত বেলে দো-আঁশ, বেলে দো-আঁশ ও এঁটেল দো-আঁশ মাটি খুবই উপযোগী। কারণ এসব মাটি রস ধরে রাখতে পারে। বর্ষার পানি যে সমস্ত জমি থেকে সহজে নেমে যায়, বৃষ্টি বা সেচের ফলে পানি জমে থাকেনা, অধিক বালি বা লবণাক্ত মাটি নয় এই ধরণের জমি গম চাষের জন্য নির্বাচন করা উত্তম। কার্তিকের শেষ সপ্তাহ থেকে অগ্রহায়নের মাঝামাঝি পর্যন্ত গমবীজ বপনের উপযুক্ত সময়। গমের ভালো ফলনের জন্য সঠিক জাত নির্বাচন, উপযুক্ত সময়ে বপন, সার ও সেচ ব্যবস্থাপনা, আগাছা দমনসহ অন্যান্য ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ। গমের উল্লেখযোগ্য জাতের মধ্যে আনন্দ, কাঞ্চন, আকবর, অগ্রাণী, প্রতিভা, গৌরব, শতাব্দী, সুফী, বিজয় ও প্রদীপ। সিলেট অঞ্চলের জন্য বারি গম ২৫ এবং বারি গম ২৬ খুবই উপযোগী। দেরিতে গম বীজ বোনা হলে বীজের পরিমান বেশি লাগে পাশাপাশি ফলনও কম হয়। এক হেক্টর জমির জন্য সাধারণতঃ ১২০ কেজি অর্থাৎ এক বিঘা জমিতে প্রায় ১৬ কেজি গম বীজ বপন করতে হয়। বীজ গজানোর ক্ষমতা পরীক্ষা করে নিতে পারলে ভালো। গজানোর হার শতকরা ৮৫ ভাগের উপরে হলে ভালো। গজানোর হার কম হলে বীজের পরিমাণ বাড়াতে হবে। গজানোর হার ৫৫ ভাগের নীচে হলে ব্যবহার করা ঠিক হবেনা। বীজ বোনার আগে (ছত্রাকনাশক দ্বারা) বীজ ভালো ভাবে শোধন করে নিতে হবে। সারিতে বা ছিটিয়ে যে কোন ভাবেই গম বীজ বোনা যায়। সারিতে বুনলে জমি তৈরির পর লাঙ্গল দিয়ে আনুমানিক ২০ সে.মি.প্রায় ৮ ইঞ্চি দূরে দূরে ও ৪-৫ সে.মি গভীরে গমবীজ বোনা ভালো। তারপর আড়াআড়ি ভাবে হালকা মই দিয়ে সারিগুলি ভালোভাবে ঢেকে দিতে হবে। বীজ বপনের পর যদি জমিতে যথেষ্ট রস না থাকে তবে হাল্কা করে একটি সেচ দিতে হবে। তাতে বীজ ভালোভাবে গজাবে। ভালো ফলনের পূর্ব শর্ত সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণে সার ব্যবহার। জমির উর্বরতার উপর সারের মাত্রা নির্ভর করে। আপনার জমির মাটি পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় পরিমাণ সার ব্যবহার করা ভাল। যদি মাটি পরীক্ষা করা সম্ভব না হয় তবে সেচের মাধ্যমে আবাদকৃত গমের জমিতে গড়ে প্রতি বিঘায় ইউরয়িা- ২৪-৩০ কেজি, টিএসপি- ১৯-২৪ কেজি, এমওপি ৫-৭ কেজি, জিপসাম- ১৫-১৬ কেজি। আর সেচ ছাড়া আবাদকৃত গমের জমিতে গড়ে প্রতি বিঘায় ইউরয়িা এবং টিএসপি- ১৯-২৪ কেজি, এমওপি- ৪-৫ কেজি, জিপসাম- ১৫-১৬ কেজি ব্যবহার করতে হবে। সেচসহ চাষের ক্ষেত্রে ইউরিয়া সারের দুই-তৃতীয়াংশ এবং অন্যান্য সারের সম্পূর্ণ অংশ শেষ চাষের আগে মাটিতে প্রয়োগ করে মই দিয়ে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। বাকী ইউরিয়া প্রথম সেচের সময় উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। সেচ ছাড়া চাষের ক্ষেত্রে ইউরিয়াসহ সব সার শেষ চাষের সময় মাটিতে প্রয়োগ করে মই দিয়ে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। তবে চারা অবস্থায় বৃষ্টি হলে বিঘা প্রতি ৫.৫ কেজি ইউরিয়া উপরিপ্রয়োগ করা হলে ফলন ভাল পাওয়া যাবে। রাসায়নিক সারের পাশাপাশি বিঘা প্রতি ১০০০-১৫০০ কেজি পঁচা গোবর বা কম্পোষ্ট সার জমি চাষের সময় ব্যবহার করা হলে ফলন ভালো হবে এবং জমির স্বাস্থ্য ঠিক থাকবে।
পাখির হাত থেকে গম বীজ রক্ষার জন্য বোনার আগে কাঁচা ও ঘন গোবরগোলা পানিতে গম বীজ ৬-১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখার পর সকালে বাতাসে শুকিয়ে ঝরঝরা করে জমিতে বুনলে বীজ তাড়াতাড়ি গজাবে এবং পাখি এই বীজগুলো খাবেও না। অল্প চাষেও গম আবাদ করা যায়। ধান কাটার পর জমিতে ‘জো’ আসার সাথে সাথে দেশী লাঙ্গল দিয়ে দুটি চাষ ও মই দিয়ে গম আবাদ করা যায়। যদি ‘জো’ না থাকে তবে হালকা সেচ দিয়ে ‘জো’ আনতে হবে। আড়াআড়িভাবে দ্বিতীয় চাষ দেয়ার পর প্রয়োজনীয় সার ছিটিয়ে বীজ বুনে মই দিতে হবে। পাওয়ার টিলার ব্যবহার করা হলে এক চাষেই গম বীজ বোনা যায়। সেচ সুবিধা থাকলে বীজ বোনার ১৭-২১ দিনের মধ্যে প্রথম সেচ দিতে হবে। সেচের সময় ইউরিয়া উপরি প্রয়োগ করা হলে ফলন ভালো পাওয়া যায়। স্বাভাবিক চাষের মত দ্বিতীয় ও তৃতীয় সেচ, শীষ বের হওয়ার সময় এবং দানা বাঁধার সময় দিলে ফলন আশানুরূপ পাওয়া যায়। মাটির ধরন বুঝে সাধারণত ২-৩ টি সেচের প্রয়োজন হয়। চারার বয়স ১৭-২১ দিন হলে অর্থাৎ চারায় তিনটি পাতা হলে প্রথম বারের মত সেচ দেয়া খুবই জরুরী। দ্বিতীয় সেচটি দিতে হবে চারার বয়স যখন ৫৫-৬০ দিন অর্থাৎ গমের শীষ বের হবার সময় এবং তৃতীয় সেচটি দতে হবে যখন চারার বয়স ৭৫-৮০ দিন অর্থাৎ দানা গঠনের সময়। নিয়ম মোতাবেক সেচ দেয়া হলে গমের ফলন ভালো পাওয়া যায়। সেচের পর জমিতে ‘জো’ এলে মাটির ওপরের আস্তর ভেঙ্গে দিতে হবে। প্রথম সেচের পর চারার বয়স যখন ২৫-৩০ দিন হবে তখন নিড়ানি দিয়ে আগাছা বাছাই করে দিতে হবে। এ সময় আগাছা দমন করা হলে গমের ফলন ভালো পাওয়া যায়। গম ফসলে সাধারণত তেমন কোন পোকার আক্রমণ দেখা যায় না। তবে গম ফসলের প্রধান শত্রু ইঁদুর অনেক ক্ষতি করে থাকে। ইঁদুরের আক্রমণ হলে ফাঁদ পেতে বা বিষটোপ দিয়ে ইঁদুর দমন করতে হবে।
বিশেষ সতর্কতা: বাংলাদেশে প্রথম ২০১৬ সালে ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে দক্ষিণাঞ্চলের যশোর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, বরিশাল ও ভোলা জেলায় গমের ব্লাস্ট রোগ আক্রমন করে। এ রোগ ছত্রাকের আক্রমনে হয়। এ রোগের প্রধান লক্ষণ শীষ বের হওয়ার পর গম ক্ষেতের কোনো এক স্থানে শীষ সাদা হয়ে যায়। অনুকুল আবহাওয়ায় দ্রুত বিস্তার হয়ে সারা জমিতে ছড়িয়ে যায়। প্রথমে শীষের আক্রান্ত স্থানে কালো দাগ পড়ে এবং আক্রান্ত স্থানের উপরের অংশ সাদা হয়ে যায়। রোগটি মূলত বীজ বাহিত। বৃষ্টির কারণে মাঠে দ্রুত এই রোগ সংক্রমন হয়ে থাকে। বীজ বপনের আগে উপযুক্ত ছত্রাকনাশক দিয়ে অবশ্যই বীজ শোধন করে নিতে হবে। জমিতে শীষ বের হওয়ার আগে একবার এবং শীষ বের হওয়ার ১২ থেকে ১৫ দিন পর আরো একবার বালাইনাশক স্প্রে করতে হবে। এই রোগটি একেবারেই নতুন তাই এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি অফিসে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিতে হবে।
- Advertisement -
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.