- Advertisement -
অপ্রচলিত ফল ও তাদের ঔষধিগুণাবলী
কৃষিবিদ মোহাইমিনুর রশিদ
ফল বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রতীক। ফল বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন, খনিজ, জৈব এসিড, হরমোন, এনজাইম সর্বোপরি ঔষধিগুণে গুণান্বিত সর্বোৎকৃষ্ট উৎস। সুস্থ, সবল ও কর্মক্ষম জাতি গঠনে সুষম খাদ্য তথা ফলের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশে প্রচলিত ও অপ্রচলিত প্রায় ১৩০ রকমের ফলের চাষ হয়ে থাকে। ফল আমাদের শরীরে রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক শক্তি গড়ে তোলে। অপ্রচলিত ফল গুলোর মধ্যেও প্রচুর পরিমান ঔষুধিগুণ রয়েছে। সিলেট অঞ্চলে পাওয়া যায় কতিপয় অপ্রচলিত ফলের ঔষধিগুণ নিচে আলোচনা করা হলো।
তৈকর
ইংরেজী নাম Toikar ও বৈজ্ঞানিক নাম Garcinia pedunculata। তৈকর মূল্যবান পুষ্টি ও ঔষধিগুণে সমৃদ্ধ একটি প্রাচীন ফল। প্রচুর পরিমান ভিটামিন সি, পটাশিয়াম, জিংক এবং আয়রন সমৃদ্ধ ফল। প্রতি ১০০ গ্রাম তৈকরে এসকরবিক এসিড প্রায় ৮০ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম প্রায় ১২৭ মিলিগ্রাম, সোডিয়াম ৩.৭ মিলিগ্রাম, আয়রন ৭ মিলিগ্রাম এবং জিংকের পরিমাণ প্রায় ১৩.২ মিলিগ্রাম। এ উপকারী ফলটি মানুষের বিবিধ রোগ দূর করার পাশাপাশি মুখে রুচি তৈরি করে। তৈকরের প্রচুর পরিমাণ এসকরবিক এসিড, ফেনলিক এবং ফ্লাবোনয়েড পদার্থ রয়েছে তাই লোক ঔষধ বা ভড়ষশ সবফরপরহব বলা হয়।
কালোজাম
জাম একটি সুমিষ্ট বহুল পরিচিত ফল। ইংরেজিতে Blackberry আর বৈজ্ঞানিক নাম Syzygium cuminii । অত্যন্ত পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ কালোজামে প্রচুর পরিমাণে ক্যারোটিন, লৌহ, ভিটামিন সি এবং ক্যালসিয়াম রয়েছে। জামের কচি পাতা পেটের পীড়া নিরাময়ে সাহায্য করে। জামের বীজ থেকে প্রাপ্ত পাউডার বহুমুত্র রোগের ঔষুধ হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। পাকা জাম সৈন্ধব লবণ মাখিয়ে ৩-৪ ঘন্টা রেখে চটকিয়ে ন্যাকড়ার পুটলি বেধেটানিয়ে রাখলে যে রস বের হয় তা ডায়রিয়া, অরুচি ও বমিভাব দূর করে। জাম ও আমের রস একত্রে পান করলে বহুমুত্র রোগীর তৃষ্ণা প্রশমিত হয়।
কামরাঙ্গা
টক মিষ্টি স্বাদে কামরাঙার বাহার। ইংরেজী নাম Carambola এবং বৈজ্ঞানিক নাম Averrhoa carambola । ভিটামিন এ এবং ভিটামিন সি সমৃদ্ধ পুষ্টিকর পাকা কামরাঙ্গা ফল বাতনাশক ও রক্তক্ষরণ বন্ধ করে । ফল এবং পাতা গরম পানিতে সিদ্ধ করে পান করলে বমি বন্ধ হয়ে যায় । পাতা ও ডগার গুড়া সেবনে জলবসন্ত ও বক্রকৃমি নিরাময় হয় । কাশি ও অ্যাজমা নিরাময় পোড়া কামরাঙ্গা খুবই কার্যকরী ।
বাতাবি লেবু
গাঁও গেরামের জাম্বুরাই আমাদের অতি প্রিয় বাতাবি লেবু। যার ইংরেজী নাম Pummelo এবং বৈজ্ঞানিক নাম Citrus grandis, বাতাবি লেবু বি-১, বি-২ ও ভিটামিন সি সমৃদ্ধ পুষ্টিকর ফল। নিয়মিত এ লেবু খেলে রক্তে কোলেস্টরল কমে। এর পাতা, ফুল ও ফলের খোসা গরম পানিতে সিদ্ধ করে পান করলে মৃগী রোগে উপশম পাওয়া যায়। তাছাড়া হাত-পা কাপা ও প্রচন্ড কাশি রোগে চমৎকার কাজ করে থাকে। সর্দি জ্বরেও খুব ভালো উপকার পাওয়া যায়। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, মুখের রুচি বৃদ্ধি করে বাতাবি লেবু।
সফেদা
বহুবর্ষজীবি খুবই সুস্বাদু ও মিষ্টি ফল সফেদা। ফলটির ইংরেজী নাম Sapota এবং বৈজ্ঞানিক নাম Achras sapota। মানব শরীরের জন্য উপকারী বিভিন্ন খনিজ পদার্থ, শর্করা, ভিটামিন সমৃদ্ধ সুস্বাদু ও অত্যন্ত পুষ্টিকর ফল সফেদা। ফলের ঠান্ডা পানি বা শরবত জ্বর নাশক হিসেবে কাজ করে । ফলের খোসা শরীরের ত্বক ও রক্তনালি দৃঢ় করে রক্তক্ষরণ বন্ধে সাহায্য করে ।
ডেউয়া
ইংরেজী নাম Monkey Jack আর বৈজ্ঞানিক নাম Atocarpus lakoocha। ভিটামিন সি ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ পাকা ফল পিত্তবিকারে ও যকৃতের পীড়ায় হিতকারী, ছালের গুড়া চামড়ার রুক্ষতায় এবং ব্রণের দূষিত পুজ বের করার জন্য হিতকর ।
চালতা
ইংরেজী নাম Indian dellenia ও বৈজ্ঞানিক নাম Dillenia india। ক্যালসিয়াম ও শর্করা সমৃদ্ধ চালতার কচি ফল পেটের গ্যাস, কফ, বাত, ও পিত্তনাশক । পাকা ফলের রস চিনিসহ পান করলে সর্দিজ্বর উপশম হয় ।
সাতকরা
সাতকরা বিশ্ব বাজারে এক সুপরিচিত নাম। ইংরেজী নাম : Satkara এবং বৈজ্ঞানিক নাম Citrus macroptera। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ সুস্বাদু ফল সাতকরা বমিনাশক, রুচিবর্ধক ও হজম সহায়ক।
ডুমুর
ইংরেজী নাম Fig এবং বৈজ্ঞানিক নাম: Ficus carica । ক্যারোটিন, ক্যালসিয়াম ও ক্যালরি সমৃদ্ধ ডুমুর ফল টিউমার ও অন্যান্য শারীরিক নিবারণে ব্যবহৃত হয়। পাতা চূর্ণ, বহুমূত্র, বৃক্ক ও যকৃতের পাথর নিরাময়ে ব্যবহৃত হয় । ডুমুর সবজি হিসেবেও ব্যবহৃত হয় ।
করমচা
কাচা করমচা গায়ের ত্বক ও রক্তনালি শক্ত ও রকÍক্ষরণ বন্ধ করে । পাতা গরম পানিতে সেদ্ব করে পান করলে কালাজ্বর নিরাময়ে উপকার পাওয়া যায় । শিকড়ের রস গায়ের চুলকানি ও কৃমি দমনে সাহায্যে করে । তাছাড়া করমচা থেকে প্রচুর পরিমান পটাশ, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও ভিটামিন সি পাওয়া যায়।
লটকন
ভিটামিন বি ২ সমৃদ্ধ লটকন অম্লমধুর ফল । ফল খেলে বমি বমি ভাব দূর হয় ও তৃষ্ণা নিবারণ হয় । শুকনো গুড়া পাতা খেলে ডায়রিয়া ও মানসিক চাপ কমায় ।
কাউফল
সর্দিজ্বর ও ঠান্ডা প্্রশমনে কাউফল উপকারী । এ ছাড়াও এটা মুখের অরুচি দূর করে ।
আমলকি
আমলকির রস যকৃত, পেটের পীড়া, হাপানি, কাশি, বহুমুত্র, অজীর্ণ ও জর¡ নিরাময়ে বিশেষ উপকারী। এর পাতার রস আমাশয় প্রতিষেধক ও বলকারক। আমলকির রসের শরবত জন্ডিস, বদহজম ও কাশির হিতকর। হাজানি, কাশি বহুমুত্র ও জ্বর নিরাময়ে এর বীজ ব্যবহার করা হয়।
বিলিম্বি
বাড়ির আনাচে কানাচে বেড়ে উঠা অপ্রচলিত ফল বিলিম্বি ফলটি দেখবে খুব সুন্দর। গাছ প্রতি ফলন এতো বেশি হয় যেন দু-চারটি গাছ দিয়েই পুরো গ্রামের চাহিদা মেটানো সম্ভব। বিলিম্বি উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়বেটিসের ঝুকি কমায়।
লুকলুকি
পাতা ও ফল ডায়রিয়া রোগের প্রতিরোধক এবং ব্রংকাইটিসের জন্য শুকনা পাতা ব্যবহার করা হয়। দাতের ব্যথা প্রশমনের জন্য পাতা ও ফল খুব ভালো কাজ করে।
বহেরা
বহেরা ফল ও ফলের মজ্জা ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয় । রক্ত আমাশয়ে বহেরার গুড়া সকাল বিকাল পরিমাণ মতো পানিসহ খেলে উপকার পাওয়া যায় । এ গাছের ফল কোষ্ঠকাঠিন্য, জন্ঢিস, কাশি, এবং রক্তক্ষরণ বন্ধে ব্যবহৃত হয়। ফলের ভেতরের অংশে ডায়রিয়া, আমাশয় এবং পাইলস নিরাময়ের জন্য বেশ কার্যকরী । আর বীজ থেকে উৎপাদিত তেল মালিশ করলে বাত সেরে যায় ।
ফল আল্লাহর দান। যে চিনতে পারে, সে নিজে নিজের চিকিৎসা করতে পারে। স্বাদে, পুষ্টি ছাড়াও অপ্রচলিত ফলগুলোর ঔষধিগুণ সমৃদ্ধ। ফল বৈচিত্র্যে আমাদের ঐতিহ্যেও অহংকার অনাদিকাল থেকে থাকলেও সময়ের আবর্তে আজ অনেক অপ্রচলিত ফল বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। সিলেট অঞ্চলেও এর প্রভাব পড়েছে। তাই হারিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের লোক সংস্কৃতি ঐতিহ্যের সাথে জড়িত অতি আপন অনেক অপ্রচলিত ফল। সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে এই মহৌষধ ফলগুলোর টিকিয়ে রেখে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার আজই সময়। জার্মপ্লাজম সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের উদ্যোগ গ্রহণ, গণসচেতনতা বৃদ্ধি, গবেষণা ও জাত সম্প্রসারণ, শিল্প কারখানা তৈরি, বাজার ব্যবস্থা গঠন ও আধুনিকায়ন এবং সর্বোপরি উদ্যোগগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়নের করতে হবে। পরিশেষে বলতে চাই
দুনিয়ার বুকে ফল বৃক্ষের সমাহার
আল্লাহর এক অপূর্ব নিয়ামত
নানারুপে নানাভাবে করে যায়
মানুষ ও পশুপাখির খেদমত।
- Advertisement -
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.