- Advertisement -
অগ্রহায়ণ মাসের কৃষি
কৃষিবিদ মোহাইমিনুর রশিদ
নবান্নের উৎসব শুরু হয় অগ্রহায়ণ । নতুন ধানের ঘ্রাণ, তরতাজা শাকসবজি, শিশিরের পরশে শীতের আমেজ এ সবকিছুই অগ্রহায়ণের আগমনি বার্তা।
আপনার জমির ধান শতকরা ৮০ ভাগ পাকলে ধান কেটে নিতে পারেন। রোদেলা দিনে ধান কেটে মাড়াই-ঝারাই করে শুকিয়ে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে। ধান মাড়াইয়ের জন্য পাওয়ার থ্রেসার বা প্যাডেল থ্রেসার ব্যবহার করতে পারেন। বীজ সংরক্ষণের আগে ৪-৫ বার ধান রোদে শুকাতে হবে যাতে বীজের আদ্রতা ১২% এর নিচে থাকে। শুকনো ধান ছায়ায় ঠান্ডা করে তারপর গোলাজাত করতে হবে। মাটির পাত্র বা প্লাষ্টিকের ড্রামে বীজ সংরক্ষণ করা ভালো। পাত্রে রাখা বীজের উপর নিমপাতা, বিশকাটালি বা ছাই ছিটিয়ে দিয়ে মুখ এমনভাবে বন্ধ করতে হবে যাতে ভিতরে বাতাস ঢুকতে না পারে। বীজ পাত্র মাচায় বা মাটি থেকে উঁচু জায়গায় রাখুন। গবাদিপ্রাণির খাবারের জন্য খড় সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করুন।
অগ্রহায়ণ মাস বোরো ধানের বীজতলা তৈরির উপযুক্ত সময়। উপযুক্ত জায়গা নির্বাচন করে আদর্শ বীজতলা তৈরি করতে হবে। উর্বর ও সেচ সুবিধা আছে এমন জমিতে বীজতলা তৈরি করা ভালো। ভালোভাবে জমি তৈরি করে চাষের আগে প্রতি বর্গমিটার জায়গার জন্য ২-৩ কেজি জৈব সার ব্যবহার করা ভালো। পানি দিয়ে জমি থকথকে কাদাময় করে এক মিটার চওড়া এবং জমির দৈর্ঘ্য অনুসারে লম্বা করে বীজতলার প্লট তৈরি করতে হবে। প্রতি দুটি প্লটের মাঝে ২৫-৩০ সে.মি নালা রাখা প্রয়োজন। এ নালার সাহায্যে সেচ, নিকাশসহ প্রয়োজনীয় পরিচর্য করা যাবে। প্রতি বর্গ মিটার বীজতলায় ৮০-১০০ গ্রাম বীজ বোনা যায়। বীজ বোনার আগে বীজ পুষ্ট ও পরিস্কার বীজ ২৪ ঘন্টা পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে। পানি ঝরার জন্য পানি থেকে তুলে ১ ঘন্টা রেখে দিতে হবে। তারপর বস্তাবন্দী অবস্থায় বা মাটির পাত্রে জাগ দিতে হবে। বোরো মৌসুমে প্রায় ৬০-৭০ ঘন্টা পর্যন্ত বীজ জাগ দিয়ে রাখতে হয়। এ সময়ের মধ্যে ধানের অঙ্কুর গজাবে। অঙ্কুরিত বীজ বীজতলায় ছিটিয়ে বপন করতে হবে। এক বিঘা জমির বীজতলা দিয়ে ২৫-৩০ বিঘা জমি রোপণ করা যায়। বোরো ধানের উন্নত জাতগুলির মধ্যে বিআর ১৪, ১৬, ১৮, ১৯ এবং ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান২৯, ব্রি ধান৩৫, ব্রি ধান৩৬, ব্রি ধান৫৮ এসব জাত উল্লেখযোগ্য।
দানা ফসলের মধ্যে আমাদের দেশে ধানের পরেই গমের স্থান। অল্প খরচে গম চাষ করে অধিক লাভবান হওয়া যায়। কার্তিক মাসের মাঝামাঝি থেকে গম বোনার কাজ শুরু হয় তবে অগ্রহায়ণের শুরু থেকে মধ্য অগ্রহায়ণ পর্যন্ত গম বোনার উপযুক্ত সময়। এরপর গম যত দেরিতে বোনা হবে ফলন তত কমতে থাকবে। গমের উন্নত জাতগুলির মধ্যে কাঞ্চন, সৌরভ, শতাব্দি, গৌরব, প্রতিভা, আনন্দ, বরকত, আকবর, সেনালীকা, অঘ্রাণী উল্লেখযোগ্য। এক হেক্টর বা সাড়ে সাত বিঘা জমিতে ১২০-১২৫ কেজি গম বীজ বোনতে হয়। গমের ভালো ফলন পেতে হলে জমির মাটি পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় সার ব্যবহার করা প্রয়োজন। সেচ দিয়ে বা সেচ ছাড়া উভয় ভাবেই গম চাষ করা যায়। সেচসহ চাষের ক্ষেত্রে বীজ বপনের ১৭-২১ দিন পর প্রথম সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। এবং ঐ সময় জমিতে কিছু ইউরিয়া উপরিপ্রয়োগ করা ভালো। গমে তিন বার সেচ দিলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। বীজ বপনের ৪৫-৬০ দিন পর ২য় সেচ এবং ৭৫-৮০ দিন পর তৃতীয় শেষ সেচ দিতে হয়।
ভূট্টা একটি বহুমূখী ফসল। এখনই ভূট্টা চাষের উপযুক্ত সময়। বৃষ্টির পানি জমে না এমন উঁচু বা মাঝারি উঁচু জমি যার মাটি বেলে দো-আঁশ বা এঁটেল দো-আঁশ এমন জমি ভূট্টা চাষের জন্য নির্বাচন করা ভালো। অগ্রহায়ন মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে বীজ বপন করা হলো ভালো ফলন পাওয়া যাবে। উল্লেখযোগ্য জাতগুলি হলো- বর্ণালী, শুভ্রা, মোহর, বারি ভূট্টা-৫ ও ৬, বারি হাইব্রিড ভূট্টা-১, প্যাসিফিক- ১১, ৬০, ৭১০। বীজ বপনের আগে বীজ শোধন করে নেয়া ভালো। ভূট্টা সারিতে রোপন করা ভালো, সারি থেকে সারির দূরত্ব ৭৫ সে.মি এবং বীজ থেকে বীজের দূরত্ব ২৫ সে.মি। মাট পরীক্ষা করে জমিতে সার ব্যবহার করতে হবে। ভূট্টা বপনের পর নিয়মিত প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করতে হবে।
তেল ফসলের মধ্যে সরিষা অন্যতম। তাছাড়াও রয়েছে তিল, তিসি, সূর্যমূখী। এসবের মধ্যে যে ফসলটি আপনার মাঠে আছে সে ফসলটির যত্ন নিতে হবে। সাধারণত তেল ফসল অবহেলিত। তবে নিয়মিত যত্ন নিলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। সরিষা গাছের বয়স ২০-২৫ দিন হলে প্রতি বিঘায় ৮.৫ কেজি ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করা ভালো। মাটিতে রস কমে গেলে ২০-২৫ দিন পর সম্ভব হলে একটি সেচ দিন।
আপনার জমিতে রোপনকৃত আলু ফসলের যত্ন নিতে হবে। এ সময় মাটির কেইল বেঁধে দেয়া, কেইলে মাটি তুলে দেয়া, সারের উপরি প্রয়োগ করা, প্রয়োজনীয় সেচ দেয়া, আগাছা পরিস্কার করা এবং রোগ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা একান্ত প্রয়োজন। মাঠে এখন অনেক শীতকালীন সবজি বাড়ন্ত পর্যায়ে আছে। ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি বড় হওয়ার সাথে সাথে চারার গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে। চারা বয়স ২-৩ সপ্তাহ হলে সারের উপরি প্রয়োগ করা দরকার। সমন্বিতভাবে সবজি ক্ষেতের আগাছা, রোগ ও পোকা মাকড় নিয়ন্ত্রণ করুন এবং প্রয়োজনীয় সেচ দিন। টমেটো গাছের অতিরিক্ত ডাল ভেঙ্গে দিয়ে খুঁটির সাথে বেঁধে দিন। আমাদের মনে রাখতে হবে সবজিতে নিয়মতান্ত্রিকভাবে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার না করে জৈব কীটনাশক ব্যবহার করা উত্তম। মিষ্টি আলু, পেঁয়াজ, চিনা, কাউন, খেসারি মসুর, মটরশুঁটি, ছোলা, মরিচ, রসুন এসব ফসলের নিয়মিত পরিচর্যাও করতে হবে।
আমাদের গৃহপালিত প্রণিদের খাবার একটি উল্লেখযোগ্য দিক। এ জন্য ধানের খড়, ভূট্টা, ডাল, ঘাস এসব শুকিয়ে সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। আপনার গৃহ পালিত পশু-পাখির রোগ প্রতিরোধে সচেতন থাকতে এব। এসময়ে আপনার গবাদি পশুর বিভিন্ন রোগ হতে পারে। প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় টিকা দেয়ার ব্যবস্থা করুন। আপনার গোয়াল ঘর, হাঁস-মুরগির খোয়ার পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যবস্থা করুন।
আমাদের শরীরের পুষ্টি জোগাতে মাছের অবদান উল্লেখযোগ্য। আপনার পুকুরে জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করুন, চুন ও জৈব সার ব্যবহার করুন। পুকুরে যাতে ভালভাবে রোদ পড়ে সেজন্য পুকুর পাড়ের গাছের ডালপালা কেটে ছেটে রাখতে হবে। পুকুর পাড়ে ঘাস চাষ করে কার্প জাতীয় মাছের খাবার সরবরাহ করতে পারেন।
- Advertisement -
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.